বারনাবাস এর ইঞ্জিল (Gospel) থেকে...পর্ব ৭
{ আগের পর্ব পড়ে না থাকলে, পড়ে আসতে অনুরোধ করছি... যদি পড়া না থাকে তাহলে 6th Part এর লিঙ্ক এখানে আর, একদম প্রথম থেকে পড়তে চাইলে, এখানে ক্লিক করুন :) }
মূল ঘটনায় প্রবেশ করার আগে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস করা কাহিনী জানা দরকার, ওদের মতে ঘটনাটা আসলে কী হয়েছিল? তাহলে কাহিনী মিলিয়ে পড়তে সুবিধা হবে। আসুন জানা যাক। আমি বাইবেলের ৪টা গস্পেল থেকে এ ঘটনার বিবরন পড়ে অতি সংক্ষেপে যতটুকু মনে পড়ে লিখছি...
খ্রিস্টানদের ভাষ্য-
গ্রেফতার এড়ানোর জন্য যীশু লুকিয়ে ছিলেন গেতশিমান বাগানে। একটু আগে তিনি লাস্ট সাপার করলেন তাঁর ১২ সাহাবীর সাথে। এরপর জুডাস বা এহুদা বেরিয়ে গেল। বাগানে প্রার্থনারত ছিলেন যীশু, বারবার তিনি প্রার্থনা করছেন যেন তাঁকে গ্রেফতার না করতে পারে, ঈশ্বর যেন তাঁকে রক্ষা করেন; আর সাহাবীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিশ্বাসঘাতক জুডাস ইহুদী ইমাম কায়াফার কাছে গেল আর ৩০ রুপার মুদ্রা দাবি করল যীশুকে ধরিয়ে দেবার বিনিময়ে। কায়াফা রাজি হলেন আর সৈন্য আনতে পাঠালেন। সৈন্য নিয়ে জুডাস রওনা হল যীশুকে ধরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে।
বাগানে এসে পোঁছাল জুডাসের দল। একটা হৈচৈ এর মধ্যে যীশু গ্রেফতার হলেন। সাহাবীরা সবাই পালিয়ে গেলেন।
যীশুকে সানহেদ্রিনে নেয়া হল। সানহেদ্রিন হল ইহুদী বিচারসভা। যীশুকে এই অভিযোগে দোষী করা হল যে, তিনি নিজেকে ঈশ্বরপুত্র দাবি করেছেন। যীশু কোন কথা বললেন না। কেবল একটা কথা বললেন, “তোমরা বলছ এ কথা।”
তাঁকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেটের (Pontius Pilete) কাছে। দাবি জানায় ইহুদী ইমামরা তাঁকে শাস্তি দেয়ার, ক্রুশে চড়ানোর। পাইলেট নিজে যীশুকে কিছু প্রশ্ন করে বললেন, তাঁর কাছে এ লোককে দোষী মনে হয়নি। তাই তাঁকে শাস্তি দিতে চান না তিনি।
তিনি যীশুকে পাঠালেন রাজা হেরোদের কাছে। হেরোদ আর তাঁর সৈন্যরা যীশুকে অপমান করল, তাঁকে ব্যঙ্গ করল। তাঁকে ইহুদীদের রাজা বলে উপহাস করল আর একটা রাজার মতো আলখাল্লা পড়িয়ে দিল। এরপর তাঁকে আবার নিয়ে আসা হল পাইলেটের কাছেই।
ইহুদী ইমামরা তখন যীশুর বিরুদ্ধে জনতাকে উত্যক্ত করে তুললো। পাইলেট তখন বললেন, প্রতি বছর এ উৎসবের সময় একজন অপরাধীকে মুক্ত করে দেয়া হয়। জনতার সামনে তিনি ২ জনকে রাখলেন, কাকে মুক্ত করে দেয়া উচিত বলে মনে করে জনতা? ১ জন ছিল যীশু খ্রিস্ট, আরেকজন ছিল কুখ্যাত খুনি যীশু বারাব্বা। দুজনের নামই ছিল যীশু, ঈসা।
জনতা রায় দিল, যীশু বারাব্বাকে ছেড়ে দেয়া হোক আর যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হোক।
পাইলেট বললেন, যীশুকে মারছ তোমরাই, আমি না। এ লোকের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী না। এর রক্তের ভার তোমাদের উপর। এটা যেন সবাই মনে রাখে। এ কথা বলে তিনি যীশুকে ক্রুশে চড়ানোর আদেশ দিলেন। (মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা কেবল রোমান গভর্নরের ছিল, ইহুদীদের ছিল না, এ জন্যই পাইলেটের কাছে আসা।)
শুরু হল যীশুকে নির্যাতন করা। তাঁকে অনেক অনেক আঘাত করা হল। তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তাঁকে মুকুট পড়ানো হল, তবে রাজার মুকুট না, কাঁটার মুকুট। তাঁর জামা খুলে নেয়া হল, টুকরো টুকরো করা হল...
নিয়মমাফিক নিজের ক্রুশ নিজেকেই বহন করতে হয়। তাই যীশুর কাঁধে চড়িয়ে দেয়া হল তাঁর ক্রুশ। প্রচণ্ড ভারি সেই ক্রুশ নিয়ে তাঁকে হেঁটে যেতে হল পাহাড়ের উপরে গল্গথা নামের স্থান পর্যন্ত। পথে তিনি বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে এক মহিলা যে যীশুর অনুসারী ছিল তাঁকে পানি খাওয়াতে এলো কিন্তু সৈন্যরা ফেলে দিল সেই পানি। সাইমন নামের এক ভক্ত তাঁর ক্রুশ বহন করতে চাইল, কিন্তু তাঁকে তাড়িয়ে দিল সৈন্যরা।
শেষ পর্যন্ত পোঁছাল সবাই পাহাড়ে। সেখানে ক্রুশ মাটিতে বিছানো হল, সেখানে শোয়ান হল যীশুকে, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক গাঁথা হল তাঁর হাতে, তাঁর পায়ে। ছিটকে বেরিয়ে এলো রক্তের স্রোত। এরপর ক্রুশ উপরে তোলা হল। তাঁর সাথে আরও ২ জন চোরকে ক্রুশে দেয়া হয়েছিল। যীশুর ক্রুশের উপর লেখা হয়েছিল, “নাসরাতের যীশু- ইহুদীদের রাজা।”
ক্রুসিফিক্সনের ঘটনার সময় সামনে যীশুর পরিচিতদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল তারা হল, ইউহানা (John), মা মেরি, আর মেরি মাগডালিন। একজন মা হয়ে নিজের চোখের সামনে সন্তানের সব কষ্ট দেখতে হল মেরিকে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। যাকে এখন খ্রিস্টানরা বলে গুড ফ্রাইডে। দুপুর ৩টার সময় যীশু চিৎকার করে উঠলেন, “ইলাহি !! ইলাহি !! লামা সাবাখতানি ???” (হে ঈশ্বর! হে ঈশ্বর!! কেন তুমি আমায় পরিত্যাগ করলে?) এরপর তিনি ধীরে ধীরে মারা গেলেন। {উল্লেখ্য, আর কোন হিব্রু বাক্য না জানলেও, উপরের এ বাক্যটি সকল খ্রিস্টান জানে, মুখস্ত করে। আর যারা খ্রিস্টধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাদেরও মুখস্ত এ বাক্যটি... মুখস্ত করে ফেললে ভাল :) }
এরপর তাঁর লাশ নামানো হল। তাঁর লাশ কোলে নিয়ে অনেক কাঁদলেন মা মেরি। কাঁদল মেরি মাগডালিন আর জন।
জোসেফ আরামাথিয়া (যে যীশুর রক্ত ধারণ করে সেই পাত্রে, হলি গ্রেইলে) ছিল অনেক ধনী। তাঁর নিজস্ব পাথরের কবরে রাখা হল যীশুকে। এত তাড়াতাড়ি কেন? কারন, শনিবার ইহুদীদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় ছুটির দিন, সাব্বাথ, ঐদিন এসব কাজ হারাম মনে করত তারা। তাই শুক্রবারেই সব কিছু শেষ করতে চাইল তারা।
পরদিন শনিবার, কিছুই হল না। সবাই শোক পালন করল।
এরপর দিন, রবিবার। ইস্টার সানডে বলে খ্রিস্টানরা এখন। সেদিন সকাল সকাল মহিলারা (মেরি মাগডালিন সহ) গেল যীশুর কবরে, সুগন্ধি দিতে। গিয়ে দেখল কবরের মুখের পাথর সরানো!! আর, যীশুর লাশ নেই!! কবর ফাঁকা! অবাক ব্যাপার!!! কাফনের কাপড় পড়ে আছে। সেই কাফনের কাপড় আজও আছে সংরক্ষন করা। এর নাম Shroud Of Turin. নামটা মনে রাখবেন।
একটা সূত্রে বলা হয়, মেরি মাগডালিন একা গেলেন ওখানে আর গিয়ে দেখলেন এক ফেরেশতাকে। “ফেরেশতা” বললেন, যীশু আবার “জীবিত” হয়েছেন। এ ঘটনাকে বলে The Resurrection of Christ.
ইতোমধ্যে একটা গুজব অবশ্য ছড়িয়ে গেল, ইহুদী নবী যীশু মিরাকল দেখিয়েছেন, তিনি আসলেই তাহলে ঈশ্বরপুত্র, মৃত্যুকে হার মানিয়েছেন তিনি!
কয়েকজন সাহাবীর কাছে দেখা দিলেন পুনর্জীবিত বা পুনরুত্থিত যীশু (The Resurrected Jesus)... তাদের সাথে কথা বললেন। আর চলে যাবার আগে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে গেলেন তিনি সাহাবীদের, তারা তাঁর ধর্ম প্রচার করতে পারবে সবার কাছে, আর এজন্য তারা সব বিদেশি ভাষায় চাইলেই কথা বলতে পারবে।
Resurrection এর ৪০ দিন পর যীশুকে আকাশে তুলে নেয়া হল, সাহাবীদের সামনে। এটাকে বলে The Ascension.
এবং, ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী তিনি আবার আসবেন, এসে হত্যা করবেন Antichristকে। এ দ্বিতীয় আগমনকে বলে The Advent of Christ.
এই হল সংক্ষেপে ঘটনা। বিস্তারিত জানার জন্য কোন প্রশ্ন মনে আসলে, কমেন্ট এ লিখুন।
অনেকগুলো, প্রায় ১০০র উপর লিখিত কপি থেকে ৩২৫ সালে পছন্দ করা হয় এ কাহিনীওয়ালা কপিগুলো। আজও এ কাহিনীই বাইবেলে আছে।
এবার আসা যাক, বারনাবাসের লিখনিতে...
তবে তাঁর আগে, একটা উদ্ধৃতি দিয়ে নেই। এটা জাবুর শরিফ থেকে নেয়া। একটা ভবিষ্যৎবাণী। পড়ে দেখুন-
“ভাল মানুষটি অনেক বিপদে পড়বে, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে রক্ষা করবেন। তিনি তাঁকে পুরোপুরি সংরক্ষন করবেন... ” (জাবুর, ৩৪:১৯-২১)
আরেকটি দেখুন-
“...নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন... তুমি দেখবে, দুষ্ট লোকটিই শাস্তি পাচ্ছে... তোমার কোন ক্ষতিই হবে না... কারণ, তিনি তোমাকে তাঁর ফেরেশতা দিয়ে রক্ষা করবেন... তারা তোমাকে তুলে নিবে... আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি তাঁকে বাঁচাবো। রক্ষা করব।’... সে আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আর আমি তাঁর প্রার্থনা শুনব। আমি তাঁকে নিয়ে আসব... তাঁকে সম্মান দিব... তাঁকে দেব সুদীর্ঘ আয়ু...” (জাবুর, ৯১:১-১৬)
এটা মাথায় রাখলেই চলবে।
আগের পর্বে ঠিক যে জায়গায় শেষ করেছিলাম, তাঁর একটু আগে থেকে শুরু করছি...
অধ্যায় ২১৪
...
ইমাম এহুদাকে গুণে গুণে (৩০ রুপার মুদ্রা) দিল। তারপর একজন ফারিসিকে পাঠিয়ে দিল রাজা হেরোদের কাছ থেকে সৈন্য আনতে। সৈন্যরা এহুদাকে নিয়ে জেরুজালেম থেকে বেরিয়ে এলো।
অধ্যায় ২১৫
সৈন্যরা এহুদার সঙ্গে ঈসার থাকার স্থানে পোঁছালে ঈসা অনেক পদশব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ভয় পেয়ে বাগানের পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন। সেখানে ১১ সাহাবী নিদ্রায় মগ্ন ছিল। তখন আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার বিপদ দেখে জিবরাঈল (Gabriel), আজ্রাইল (Uriel), মিকাইল (Michael) আর ইসরাফিলকে (Raphael) আদেশ দিলেন ঈসাকে তুলে আনার জন্য। ফেরেশতারা এসে ঈসাকে সেই ঘরেরই দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে বের করে নিল। আসমানে ফেরেস্তাদের সাথে রেখে আসলেন ঈসাকে।
অধ্যায় ২১৬
ঠিক তখনই এহুদা ঘরে ঢুকল। দেখল সবাই ঘুমাচ্ছে। তখনই মহান আল্লাহ তাঁর ক্ষমতা দেখালেন। তিনি এহুদার চেহারা (এমনকি কণ্ঠস্বরও) এমনভাবে পরিবর্তন করে দিলেন যে, যে কেউ তাঁকে দেখে ঈসা মনে করত। সে আমাদের জাগিয়ে তুলল। জিজ্ঞেস করতে লাগল, “প্রভু কোথায়???”
আমরা বিস্মিত হয়ে বললাম, “আপনিই তো আমাদের প্রভু। আপনি কি ভুলে গেছেন আমাদের?” (আমরা তো জানতাম না যে সে এহুদা, পরে জেনেছি।)
সে হেসে বলল, “ঠাট্টা থামাও তো, তোমরা জানই যে আমি এহুদা ইস্কারিওত।” ঠিক তখনই সৈন্যরা ঘরে ঢুকে পড়ল আর এহুদাকে ঈসা ভেবে ধরে ফেলল। (তাদেরই বা কী দোষ?) আমরা সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলাম। ইউহানার (জন) গায়ে লিনেনের কাপড় ছিল, সে পালানোর সময় এক সৈন্য তাঁর কাপড় ধরে ফেলে, তাই সে কাপড় ফেলেই নগ্ন হয়ে দৌড় দেয়। আল্লাহ ঈসার বাকি ১১জন সাহাবীকে বাঁচিয়ে দিলেন।
অধ্যায় ২১৭
সৈন্যরা এহুদাকে জোর করে বাধল কারণ সে বার বার বলছিল সে নাকি ঈসা নয়। সৈন্যরা তাঁকে টিটকারি দিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে ইসরায়েলের রাজা বানাব। আমরা তোমাকে বাঁধছি কারণ তুমি রাজা হতে চাও না।”
এহুদা বলল, “বোকা কোথাকার! তোমরা এসেছ ঈসা নাসারাকে নিতে, তাঁর বদলে তোমরা তোমাদের পথপ্রদর্শককে ধরেছ। কেন???”
সৈন্যরা ধৈর্য হারাল। তারা তাঁকে ঘুষি-চড়-লাথি মারতে মারতে জেরুজালেমে নিয়ে গেল। ইউহানা আর পিটার পিছনে পিছনে গেল, তারা এসে আমাকে সব জানাল কী কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। ফারিসিদের আদালত সানহেদ্রিন তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিল। এহুদার কথাগুলো সবার কাছে পাগলামি মনে হল। সবাই হাসল শুনে শুনে। সবাই বুঝে নিল, সে আসলে ঈসা, মৃত্যুভয়ে মিথ্যা বলছে, পাগলের ভ্যান ধরেছে।
তারা তাঁর চোখ বেঁধে দিল, তারপর পিছন থেকে মেরে বলল, “বল তো, নাসারাতের নবী ঈসা, কে তোমাকে মারছে?” ইহুদীরা তাঁর গায়ে থুথু ছিটাল।
মোট কথা, ইহুদী ইমাম আর ফারিসিরা এহুদাকে ঈসা ভেবে মৃত্যুদণ্ড দিল। আচ্ছা, আমি কেন বলছি যে ইহুদী ইমামেরা তাঁকে ঈসা ভেবেছিলো? এমনকি তাঁর সাহাবীরা (আমিও) পর্যন্ত তাই ভেবেছিলো, ইনিই ঈসা। কী বলব আর, ঈসার মা মরিয়ম পর্যন্ত তাই ভেবেছিলেন। তিনি অনেক কেঁদেছিলেন।
আল্লাহর কসম, আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, ঈসা কী বলেছিলেন। তিনি তো বলেছিলেনই, তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হবে, তাঁর বদলে অন্য একজন কষ্টভোগ করবে। তিনি দুনিয়ার আয়ুর শেষ দিকে কিয়ামতের আগে আগে মরবেন, এর আগে নয়। (ভুলে গেলাম !)
যাই হোক, প্রধান ইমাম কায়াফা এহুদাকে তাঁর সামনে বেঁধে আনার হুকুম দিল। এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করল তাঁর প্রচারিত ধর্ম আর তাঁর সাহাবীদের কথা। এহুদা কোন কথাই বলল না। তখন ইমাম ইসরাইলের আল্লাহর নামে কসম খেয়ে তাঁকে সত্য কথা বলতে বলল। সে কি ঈসা না? সে কি নবী দাবি করে নি? সে কি ঈশ্বরপুত্র দাবি করেনি?
এহুদা বলল, “তোমরা বলছ এ কথা। আমি না। আমি তো বলেছি, আমি এহুদা। আমিই তোমাদের হাতে ঈসাকে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু, তোমরা দেখি পাগল হয়ে গেছ। ভাবছ, আমি ঈসা।”
প্রধান ইমাম বলল, “ভণ্ড কোথাকার! তুমি সাড়া ইসরাইলবাসীকে ঠকিয়েছ! সেই গালিলি থেকে শুরু করে এই জেরুজেলেম পর্যন্ত! সবার মন ভুলিয়েছ মুজেজার নামে ভণ্ড জাদু দিয়ে, আর এখন ভাবছ কেবল পাগলামির অভিনয় করে শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাবে? আল্লাহর কসম, সেটা হবে না। কখনও না!!”
এ কথা বলে ইমাম তাঁকে লাথি আর চাবুক মারার হুকুম দিল, যেন তাঁর মাথায় বুদ্ধি ফিরে আসে। এহুদা তাদের হাতে যে নির্যাতন ভোগ করতে লাগল, সেটা কোথায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তাঁর উপর নির্যাতন দেখে তাঁর শত্রুর হৃদয় পর্যন্ত মায়ায় গলে যেত। কিন্তু প্রধান ইমাম আর ফারিসিরা ঈসার প্রতি এতই মনঃক্ষুণ্ণ ছিল যে, এহুদাকে ঈসা ভেবে তাঁর শাস্তিতে পাশবিক আনন্দ উপভোগ করা শুরু করল। (এত ক্ষোভ কেন? কারণ, ঈসা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন, ইহুদী ইমামেরা জনগণের দানের টাকা আত্মসাৎ করে)
এরপর তারা এহুদাকে বেঁধে নিয়ে গেল গভর্নর পাইলেটের কাছে। কেউ জানত না যে, পাইলেট গোপনে ঈসাকে বিশ্বাস করতেন আর ভালবাসতেন। তাই পাইলেট তাঁকে তাঁর কক্ষে একা ঢুকতে দিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর প্রতি কেন সবাই এমন করছে? অবশ্য, তিনি এহুদাকে ঈসা ভেবেছিলেন।
এহুদা বলল, “আরে! আপনিও দেখি ওদের মতো পাগল হয়ে গিয়েছেন!”
গভর্নর বুঝতে পারলেন না। তিনি তাঁর সাথে পাক কিতাবের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলেন, “জান তো, আমি একজন ইহুদী না? আমাকে সত্যি কথা বল। আমি ন্যায়বিচার করব। আমার হাতে তোমাকে মুক্ত করার আবার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতাও আছে।”
এহুদা বলল, “বিশ্বাস করুন, আপনি আমাকে মারলে একজন নিরপরাধ লোককে মারা হবে; দেখুন, আমি তো এহুদা ইস্কারিয়ত; ঈসা নাসারা নই। ঈসা একজন জাদুকর। সে তাঁর জাদু দিয়ে আমার চেহারা বদলে দিয়েছে।”
এ কথা শুনে গভর্নর পাইলেট খুবই আশ্চর্য হলেন, তিনি তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইলেন। তিনি বেরিয়ে এসে বললেন, “আমি তো এ লোকের মধ্যে কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না...”
-0- -0- -0-
এতটুকু পর্যন্ত এ পর্বে লিখলাম। শেষে কুরআনের ২টি আয়াত দিচ্ছি এখন, যেটা খ্রিস্টানদের সাথে ডিবেটে বার বার উদ্ধৃতি দেয়া লাগে, ক্রুশবিদ্ধ প্রসঙ্গ আসলেই... :)
“আর ইহুদীরা বলে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না তাঁকে ক্রুশে চড়িয়েছে, বরং তাদের এরুপ মনে হয়েছিল। আসলে, তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। এটা নিশ্চিত, তাঁকে তারা হত্যা করেনি। বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তাআলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (নিসা, ৪:১৫৭-৮)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
পরের পর্বে থাকবে ক্রুশের বাকি ঘটনা। আর থাকবে, বারনাবাস বা অন্য সাহাবীরা কীভাবে জানল আসল ঘটনা???
মূল ঘটনায় প্রবেশ করার আগে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস করা কাহিনী জানা দরকার, ওদের মতে ঘটনাটা আসলে কী হয়েছিল? তাহলে কাহিনী মিলিয়ে পড়তে সুবিধা হবে। আসুন জানা যাক। আমি বাইবেলের ৪টা গস্পেল থেকে এ ঘটনার বিবরন পড়ে অতি সংক্ষেপে যতটুকু মনে পড়ে লিখছি...
খ্রিস্টানদের ভাষ্য-
গ্রেফতার এড়ানোর জন্য যীশু লুকিয়ে ছিলেন গেতশিমান বাগানে। একটু আগে তিনি লাস্ট সাপার করলেন তাঁর ১২ সাহাবীর সাথে। এরপর জুডাস বা এহুদা বেরিয়ে গেল। বাগানে প্রার্থনারত ছিলেন যীশু, বারবার তিনি প্রার্থনা করছেন যেন তাঁকে গ্রেফতার না করতে পারে, ঈশ্বর যেন তাঁকে রক্ষা করেন; আর সাহাবীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিশ্বাসঘাতক জুডাস ইহুদী ইমাম কায়াফার কাছে গেল আর ৩০ রুপার মুদ্রা দাবি করল যীশুকে ধরিয়ে দেবার বিনিময়ে। কায়াফা রাজি হলেন আর সৈন্য আনতে পাঠালেন। সৈন্য নিয়ে জুডাস রওনা হল যীশুকে ধরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে।
বাগানে এসে পোঁছাল জুডাসের দল। একটা হৈচৈ এর মধ্যে যীশু গ্রেফতার হলেন। সাহাবীরা সবাই পালিয়ে গেলেন।
যীশুকে সানহেদ্রিনে নেয়া হল। সানহেদ্রিন হল ইহুদী বিচারসভা। যীশুকে এই অভিযোগে দোষী করা হল যে, তিনি নিজেকে ঈশ্বরপুত্র দাবি করেছেন। যীশু কোন কথা বললেন না। কেবল একটা কথা বললেন, “তোমরা বলছ এ কথা।”
তাঁকে তখন নিয়ে যাওয়া হয় গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেটের (Pontius Pilete) কাছে। দাবি জানায় ইহুদী ইমামরা তাঁকে শাস্তি দেয়ার, ক্রুশে চড়ানোর। পাইলেট নিজে যীশুকে কিছু প্রশ্ন করে বললেন, তাঁর কাছে এ লোককে দোষী মনে হয়নি। তাই তাঁকে শাস্তি দিতে চান না তিনি।
তিনি যীশুকে পাঠালেন রাজা হেরোদের কাছে। হেরোদ আর তাঁর সৈন্যরা যীশুকে অপমান করল, তাঁকে ব্যঙ্গ করল। তাঁকে ইহুদীদের রাজা বলে উপহাস করল আর একটা রাজার মতো আলখাল্লা পড়িয়ে দিল। এরপর তাঁকে আবার নিয়ে আসা হল পাইলেটের কাছেই।
ইহুদী ইমামরা তখন যীশুর বিরুদ্ধে জনতাকে উত্যক্ত করে তুললো। পাইলেট তখন বললেন, প্রতি বছর এ উৎসবের সময় একজন অপরাধীকে মুক্ত করে দেয়া হয়। জনতার সামনে তিনি ২ জনকে রাখলেন, কাকে মুক্ত করে দেয়া উচিত বলে মনে করে জনতা? ১ জন ছিল যীশু খ্রিস্ট, আরেকজন ছিল কুখ্যাত খুনি যীশু বারাব্বা। দুজনের নামই ছিল যীশু, ঈসা।
জনতা রায় দিল, যীশু বারাব্বাকে ছেড়ে দেয়া হোক আর যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হোক।
পাইলেট বললেন, যীশুকে মারছ তোমরাই, আমি না। এ লোকের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী না। এর রক্তের ভার তোমাদের উপর। এটা যেন সবাই মনে রাখে। এ কথা বলে তিনি যীশুকে ক্রুশে চড়ানোর আদেশ দিলেন। (মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা কেবল রোমান গভর্নরের ছিল, ইহুদীদের ছিল না, এ জন্যই পাইলেটের কাছে আসা।)
শুরু হল যীশুকে নির্যাতন করা। তাঁকে অনেক অনেক আঘাত করা হল। তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তাঁকে মুকুট পড়ানো হল, তবে রাজার মুকুট না, কাঁটার মুকুট। তাঁর জামা খুলে নেয়া হল, টুকরো টুকরো করা হল...
নিয়মমাফিক নিজের ক্রুশ নিজেকেই বহন করতে হয়। তাই যীশুর কাঁধে চড়িয়ে দেয়া হল তাঁর ক্রুশ। প্রচণ্ড ভারি সেই ক্রুশ নিয়ে তাঁকে হেঁটে যেতে হল পাহাড়ের উপরে গল্গথা নামের স্থান পর্যন্ত। পথে তিনি বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে এক মহিলা যে যীশুর অনুসারী ছিল তাঁকে পানি খাওয়াতে এলো কিন্তু সৈন্যরা ফেলে দিল সেই পানি। সাইমন নামের এক ভক্ত তাঁর ক্রুশ বহন করতে চাইল, কিন্তু তাঁকে তাড়িয়ে দিল সৈন্যরা।
শেষ পর্যন্ত পোঁছাল সবাই পাহাড়ে। সেখানে ক্রুশ মাটিতে বিছানো হল, সেখানে শোয়ান হল যীশুকে, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক গাঁথা হল তাঁর হাতে, তাঁর পায়ে। ছিটকে বেরিয়ে এলো রক্তের স্রোত। এরপর ক্রুশ উপরে তোলা হল। তাঁর সাথে আরও ২ জন চোরকে ক্রুশে দেয়া হয়েছিল। যীশুর ক্রুশের উপর লেখা হয়েছিল, “নাসরাতের যীশু- ইহুদীদের রাজা।”
ক্রুসিফিক্সনের ঘটনার সময় সামনে যীশুর পরিচিতদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল তারা হল, ইউহানা (John), মা মেরি, আর মেরি মাগডালিন। একজন মা হয়ে নিজের চোখের সামনে সন্তানের সব কষ্ট দেখতে হল মেরিকে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। যাকে এখন খ্রিস্টানরা বলে গুড ফ্রাইডে। দুপুর ৩টার সময় যীশু চিৎকার করে উঠলেন, “ইলাহি !! ইলাহি !! লামা সাবাখতানি ???” (হে ঈশ্বর! হে ঈশ্বর!! কেন তুমি আমায় পরিত্যাগ করলে?) এরপর তিনি ধীরে ধীরে মারা গেলেন। {উল্লেখ্য, আর কোন হিব্রু বাক্য না জানলেও, উপরের এ বাক্যটি সকল খ্রিস্টান জানে, মুখস্ত করে। আর যারা খ্রিস্টধর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাদেরও মুখস্ত এ বাক্যটি... মুখস্ত করে ফেললে ভাল :) }
এরপর তাঁর লাশ নামানো হল। তাঁর লাশ কোলে নিয়ে অনেক কাঁদলেন মা মেরি। কাঁদল মেরি মাগডালিন আর জন।
জোসেফ আরামাথিয়া (যে যীশুর রক্ত ধারণ করে সেই পাত্রে, হলি গ্রেইলে) ছিল অনেক ধনী। তাঁর নিজস্ব পাথরের কবরে রাখা হল যীশুকে। এত তাড়াতাড়ি কেন? কারন, শনিবার ইহুদীদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় ছুটির দিন, সাব্বাথ, ঐদিন এসব কাজ হারাম মনে করত তারা। তাই শুক্রবারেই সব কিছু শেষ করতে চাইল তারা।
পরদিন শনিবার, কিছুই হল না। সবাই শোক পালন করল।
এরপর দিন, রবিবার। ইস্টার সানডে বলে খ্রিস্টানরা এখন। সেদিন সকাল সকাল মহিলারা (মেরি মাগডালিন সহ) গেল যীশুর কবরে, সুগন্ধি দিতে। গিয়ে দেখল কবরের মুখের পাথর সরানো!! আর, যীশুর লাশ নেই!! কবর ফাঁকা! অবাক ব্যাপার!!! কাফনের কাপড় পড়ে আছে। সেই কাফনের কাপড় আজও আছে সংরক্ষন করা। এর নাম Shroud Of Turin. নামটা মনে রাখবেন।
একটা সূত্রে বলা হয়, মেরি মাগডালিন একা গেলেন ওখানে আর গিয়ে দেখলেন এক ফেরেশতাকে। “ফেরেশতা” বললেন, যীশু আবার “জীবিত” হয়েছেন। এ ঘটনাকে বলে The Resurrection of Christ.
ইতোমধ্যে একটা গুজব অবশ্য ছড়িয়ে গেল, ইহুদী নবী যীশু মিরাকল দেখিয়েছেন, তিনি আসলেই তাহলে ঈশ্বরপুত্র, মৃত্যুকে হার মানিয়েছেন তিনি!
কয়েকজন সাহাবীর কাছে দেখা দিলেন পুনর্জীবিত বা পুনরুত্থিত যীশু (The Resurrected Jesus)... তাদের সাথে কথা বললেন। আর চলে যাবার আগে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে গেলেন তিনি সাহাবীদের, তারা তাঁর ধর্ম প্রচার করতে পারবে সবার কাছে, আর এজন্য তারা সব বিদেশি ভাষায় চাইলেই কথা বলতে পারবে।
Resurrection এর ৪০ দিন পর যীশুকে আকাশে তুলে নেয়া হল, সাহাবীদের সামনে। এটাকে বলে The Ascension.
এবং, ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী তিনি আবার আসবেন, এসে হত্যা করবেন Antichristকে। এ দ্বিতীয় আগমনকে বলে The Advent of Christ.
এই হল সংক্ষেপে ঘটনা। বিস্তারিত জানার জন্য কোন প্রশ্ন মনে আসলে, কমেন্ট এ লিখুন।
অনেকগুলো, প্রায় ১০০র উপর লিখিত কপি থেকে ৩২৫ সালে পছন্দ করা হয় এ কাহিনীওয়ালা কপিগুলো। আজও এ কাহিনীই বাইবেলে আছে।
এবার আসা যাক, বারনাবাসের লিখনিতে...
তবে তাঁর আগে, একটা উদ্ধৃতি দিয়ে নেই। এটা জাবুর শরিফ থেকে নেয়া। একটা ভবিষ্যৎবাণী। পড়ে দেখুন-
“ভাল মানুষটি অনেক বিপদে পড়বে, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে রক্ষা করবেন। তিনি তাঁকে পুরোপুরি সংরক্ষন করবেন... ” (জাবুর, ৩৪:১৯-২১)
আরেকটি দেখুন-
“...নিশ্চয়ই তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন... তুমি দেখবে, দুষ্ট লোকটিই শাস্তি পাচ্ছে... তোমার কোন ক্ষতিই হবে না... কারণ, তিনি তোমাকে তাঁর ফেরেশতা দিয়ে রক্ষা করবেন... তারা তোমাকে তুলে নিবে... আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি তাঁকে বাঁচাবো। রক্ষা করব।’... সে আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আর আমি তাঁর প্রার্থনা শুনব। আমি তাঁকে নিয়ে আসব... তাঁকে সম্মান দিব... তাঁকে দেব সুদীর্ঘ আয়ু...” (জাবুর, ৯১:১-১৬)
এটা মাথায় রাখলেই চলবে।
আগের পর্বে ঠিক যে জায়গায় শেষ করেছিলাম, তাঁর একটু আগে থেকে শুরু করছি...
অধ্যায় ২১৪
...
ইমাম এহুদাকে গুণে গুণে (৩০ রুপার মুদ্রা) দিল। তারপর একজন ফারিসিকে পাঠিয়ে দিল রাজা হেরোদের কাছ থেকে সৈন্য আনতে। সৈন্যরা এহুদাকে নিয়ে জেরুজালেম থেকে বেরিয়ে এলো।
অধ্যায় ২১৫
সৈন্যরা এহুদার সঙ্গে ঈসার থাকার স্থানে পোঁছালে ঈসা অনেক পদশব্দ শুনতে পেলেন। তিনি ভয় পেয়ে বাগানের পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন। সেখানে ১১ সাহাবী নিদ্রায় মগ্ন ছিল। তখন আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার বিপদ দেখে জিবরাঈল (Gabriel), আজ্রাইল (Uriel), মিকাইল (Michael) আর ইসরাফিলকে (Raphael) আদেশ দিলেন ঈসাকে তুলে আনার জন্য। ফেরেশতারা এসে ঈসাকে সেই ঘরেরই দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে বের করে নিল। আসমানে ফেরেস্তাদের সাথে রেখে আসলেন ঈসাকে।
অধ্যায় ২১৬
ঠিক তখনই এহুদা ঘরে ঢুকল। দেখল সবাই ঘুমাচ্ছে। তখনই মহান আল্লাহ তাঁর ক্ষমতা দেখালেন। তিনি এহুদার চেহারা (এমনকি কণ্ঠস্বরও) এমনভাবে পরিবর্তন করে দিলেন যে, যে কেউ তাঁকে দেখে ঈসা মনে করত। সে আমাদের জাগিয়ে তুলল। জিজ্ঞেস করতে লাগল, “প্রভু কোথায়???”
আমরা বিস্মিত হয়ে বললাম, “আপনিই তো আমাদের প্রভু। আপনি কি ভুলে গেছেন আমাদের?” (আমরা তো জানতাম না যে সে এহুদা, পরে জেনেছি।)
সে হেসে বলল, “ঠাট্টা থামাও তো, তোমরা জানই যে আমি এহুদা ইস্কারিওত।” ঠিক তখনই সৈন্যরা ঘরে ঢুকে পড়ল আর এহুদাকে ঈসা ভেবে ধরে ফেলল। (তাদেরই বা কী দোষ?) আমরা সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলাম। ইউহানার (জন) গায়ে লিনেনের কাপড় ছিল, সে পালানোর সময় এক সৈন্য তাঁর কাপড় ধরে ফেলে, তাই সে কাপড় ফেলেই নগ্ন হয়ে দৌড় দেয়। আল্লাহ ঈসার বাকি ১১জন সাহাবীকে বাঁচিয়ে দিলেন।
অধ্যায় ২১৭
সৈন্যরা এহুদাকে জোর করে বাধল কারণ সে বার বার বলছিল সে নাকি ঈসা নয়। সৈন্যরা তাঁকে টিটকারি দিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে ইসরায়েলের রাজা বানাব। আমরা তোমাকে বাঁধছি কারণ তুমি রাজা হতে চাও না।”
এহুদা বলল, “বোকা কোথাকার! তোমরা এসেছ ঈসা নাসারাকে নিতে, তাঁর বদলে তোমরা তোমাদের পথপ্রদর্শককে ধরেছ। কেন???”
সৈন্যরা ধৈর্য হারাল। তারা তাঁকে ঘুষি-চড়-লাথি মারতে মারতে জেরুজালেমে নিয়ে গেল। ইউহানা আর পিটার পিছনে পিছনে গেল, তারা এসে আমাকে সব জানাল কী কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। ফারিসিদের আদালত সানহেদ্রিন তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিল। এহুদার কথাগুলো সবার কাছে পাগলামি মনে হল। সবাই হাসল শুনে শুনে। সবাই বুঝে নিল, সে আসলে ঈসা, মৃত্যুভয়ে মিথ্যা বলছে, পাগলের ভ্যান ধরেছে।
তারা তাঁর চোখ বেঁধে দিল, তারপর পিছন থেকে মেরে বলল, “বল তো, নাসারাতের নবী ঈসা, কে তোমাকে মারছে?” ইহুদীরা তাঁর গায়ে থুথু ছিটাল।
মোট কথা, ইহুদী ইমাম আর ফারিসিরা এহুদাকে ঈসা ভেবে মৃত্যুদণ্ড দিল। আচ্ছা, আমি কেন বলছি যে ইহুদী ইমামেরা তাঁকে ঈসা ভেবেছিলো? এমনকি তাঁর সাহাবীরা (আমিও) পর্যন্ত তাই ভেবেছিলো, ইনিই ঈসা। কী বলব আর, ঈসার মা মরিয়ম পর্যন্ত তাই ভেবেছিলেন। তিনি অনেক কেঁদেছিলেন।
আল্লাহর কসম, আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, ঈসা কী বলেছিলেন। তিনি তো বলেছিলেনই, তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হবে, তাঁর বদলে অন্য একজন কষ্টভোগ করবে। তিনি দুনিয়ার আয়ুর শেষ দিকে কিয়ামতের আগে আগে মরবেন, এর আগে নয়। (ভুলে গেলাম !)
যাই হোক, প্রধান ইমাম কায়াফা এহুদাকে তাঁর সামনে বেঁধে আনার হুকুম দিল। এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করল তাঁর প্রচারিত ধর্ম আর তাঁর সাহাবীদের কথা। এহুদা কোন কথাই বলল না। তখন ইমাম ইসরাইলের আল্লাহর নামে কসম খেয়ে তাঁকে সত্য কথা বলতে বলল। সে কি ঈসা না? সে কি নবী দাবি করে নি? সে কি ঈশ্বরপুত্র দাবি করেনি?
এহুদা বলল, “তোমরা বলছ এ কথা। আমি না। আমি তো বলেছি, আমি এহুদা। আমিই তোমাদের হাতে ঈসাকে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু, তোমরা দেখি পাগল হয়ে গেছ। ভাবছ, আমি ঈসা।”
প্রধান ইমাম বলল, “ভণ্ড কোথাকার! তুমি সাড়া ইসরাইলবাসীকে ঠকিয়েছ! সেই গালিলি থেকে শুরু করে এই জেরুজেলেম পর্যন্ত! সবার মন ভুলিয়েছ মুজেজার নামে ভণ্ড জাদু দিয়ে, আর এখন ভাবছ কেবল পাগলামির অভিনয় করে শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাবে? আল্লাহর কসম, সেটা হবে না। কখনও না!!”
এ কথা বলে ইমাম তাঁকে লাথি আর চাবুক মারার হুকুম দিল, যেন তাঁর মাথায় বুদ্ধি ফিরে আসে। এহুদা তাদের হাতে যে নির্যাতন ভোগ করতে লাগল, সেটা কোথায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তাঁর উপর নির্যাতন দেখে তাঁর শত্রুর হৃদয় পর্যন্ত মায়ায় গলে যেত। কিন্তু প্রধান ইমাম আর ফারিসিরা ঈসার প্রতি এতই মনঃক্ষুণ্ণ ছিল যে, এহুদাকে ঈসা ভেবে তাঁর শাস্তিতে পাশবিক আনন্দ উপভোগ করা শুরু করল। (এত ক্ষোভ কেন? কারণ, ঈসা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন, ইহুদী ইমামেরা জনগণের দানের টাকা আত্মসাৎ করে)
এরপর তারা এহুদাকে বেঁধে নিয়ে গেল গভর্নর পাইলেটের কাছে। কেউ জানত না যে, পাইলেট গোপনে ঈসাকে বিশ্বাস করতেন আর ভালবাসতেন। তাই পাইলেট তাঁকে তাঁর কক্ষে একা ঢুকতে দিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর প্রতি কেন সবাই এমন করছে? অবশ্য, তিনি এহুদাকে ঈসা ভেবেছিলেন।
এহুদা বলল, “আরে! আপনিও দেখি ওদের মতো পাগল হয়ে গিয়েছেন!”
গভর্নর বুঝতে পারলেন না। তিনি তাঁর সাথে পাক কিতাবের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলেন, “জান তো, আমি একজন ইহুদী না? আমাকে সত্যি কথা বল। আমি ন্যায়বিচার করব। আমার হাতে তোমাকে মুক্ত করার আবার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতাও আছে।”
এহুদা বলল, “বিশ্বাস করুন, আপনি আমাকে মারলে একজন নিরপরাধ লোককে মারা হবে; দেখুন, আমি তো এহুদা ইস্কারিয়ত; ঈসা নাসারা নই। ঈসা একজন জাদুকর। সে তাঁর জাদু দিয়ে আমার চেহারা বদলে দিয়েছে।”
এ কথা শুনে গভর্নর পাইলেট খুবই আশ্চর্য হলেন, তিনি তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইলেন। তিনি বেরিয়ে এসে বললেন, “আমি তো এ লোকের মধ্যে কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না...”
-0- -0- -0-
এতটুকু পর্যন্ত এ পর্বে লিখলাম। শেষে কুরআনের ২টি আয়াত দিচ্ছি এখন, যেটা খ্রিস্টানদের সাথে ডিবেটে বার বার উদ্ধৃতি দেয়া লাগে, ক্রুশবিদ্ধ প্রসঙ্গ আসলেই... :)
“আর ইহুদীরা বলে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না তাঁকে ক্রুশে চড়িয়েছে, বরং তাদের এরুপ মনে হয়েছিল। আসলে, তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। এটা নিশ্চিত, তাঁকে তারা হত্যা করেনি। বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তাআলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (নিসা, ৪:১৫৭-৮)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
পরের পর্বে থাকবে ক্রুশের বাকি ঘটনা। আর থাকবে, বারনাবাস বা অন্য সাহাবীরা কীভাবে জানল আসল ঘটনা???
লেখককে ফলো করুন
|
© 2013 by Ask Islam Bangla.