দেশপ্রেম নয় বরং দেশপ্রেম ত্যাগ করাই হল ঈমানের অঙ্গ
আমাদের সমাজে একটা কথা বহুল প্রচলিত। আর তা হল “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।” এ ব্যাপারে আরো কথা হল এই কথাটাকে রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই কথাটাকে যখন তখন অনেকেই যেখানে সেখানে চালিয়ে দেন। দেশপ্রেম দেশপ্রেম করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তোলা বেশীরভাগ লোককেই আবার দেখা যায় দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণে কোন ভূমিকা না রাখতে। এদের দেশপ্রেম তাদের জিহবার আগায় এবং গোষ্ঠি-চিন্তাতেই শুধু সীমাবদ্ধ।
দেশপ্রেম সংক্রান্ত প্রকৃত কথা হচ্ছে এই বিষয়টা মানুষের সহজাত। মানুষ তার দেশকে ভালবাসে। যে জমিনে তার জন্ম হয়েছে, যে আকাশের নীচে সে বড় হয়েছে, যে আলো-বাতাসে সে বেড়ে উঠেছে সে মাটির প্রতি তার সহজাত মমত্ববোধ ও আকর্ষণ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। অনেকেই আবার এই দেশ - যা মূলত একটা ভৌগলিক পরিপার্শ্ব - এর সাথে রাষ্ট্রকে – যার সাথে সম্পর্ক হচ্ছে সরকার ও সার্বভৌমত্বের – তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এইজন্য কোন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধিতা করা অথবা রাষ্ট্রের উদ্ভবের বিরোধিতা মানে দেশপ্রেমহীনতা নয়।
যাইহোক, আসল কথায় আসা যাক। সেটা হল “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ” বলে বহুল প্রচলিত কথাটা রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) এর কথা নয়। রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) থেকে যা প্রমাণিত তা বরং এর বিপরীত। একজন ঈমানদারের কাছে কোন একটা ভূখণ্ডের বিশেষ কোন মর্যাদা নেই শুধু সেই ভূখণ্ড ছাড়া যাকে আল্লাহ তা‘আলা মর্যাদা দিয়েছেন। ঈমানের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে কুরবানী দেয়াই হচ্ছে ঈমানদারের কাছে তাঁর বিশ্বাসের দাবী। রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) এর কাছ থেকে আমরা এমন বর্ণনাই বরং পাই।
সাবরা ইবন আবিল ফাকিহ (রাদিয়া আল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন, “আমি রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ নিশ্চয়ই শয়তান বনী আদমের প্রত্যেকটা পথের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সে তার ইসলাম গ্রহণের পথে ওঁৎ পেতে বসে এবং তাকে বলে, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে তোমার পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের দীন ছেড়ে দিয়ে?’ কিন্তু সে শয়তানকে অমান্য করে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর সে [শয়তান] তার হিজরতের রাস্তায় ওঁৎ পেতে বসে এবং বলে, ‘তুমি নিজের জমিন ও আসমানকে [দেশপ্রেম] ত্যাগ করে হিজরত করবে?’ কিন্তু হিজরতকারীর অবস্থা হচ্ছে দীর্ঘ সফরে নিয়োজিত আরোহীর মত। সে তাকে [শয়তানকে] অমান্য করে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত সম্পন্ন করে। এরপর সে তার জিহাদের রাস্তায় ওঁৎ পাতে এবং তাকে বলে, ‘[তুমি জিহাদ করবে অথচ] এটা হচ্ছে জীবন ও সম্পদ ব্যয়ের সংগ্রাম; এতে তুমি লড়াই করবে ও নিহত হবে; এবং তোমার স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিয়ে দেয়া হবে ও তোমার সম্পদ ভাগ করে দেয়া হবে?’’’ তিনি (সঃ) বললেন, সে [মুজাহিদ] তাকে [শয়তান] অমান্য করবে এবং জিহাদ করবে। এরপর রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘যে এরূপ করেছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা সে যদি নিহত হয় তাহলে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা সে যদি ডুবে মারা যায় তাহলে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা তার সওয়ারী জন্তু যদি তাকে ফেলে পদদলিত করে তাহলেও আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।” [মুসনাদ ইমাম আহমদ – মুসনাদ আল-মাক্কিয়ীন]
যারা আল্লাহর রাস্তায় দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি তাদের জন্য আল্লাহর সামনে কোন হুজ্জত [দলীল/প্রমান] নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
“যারা নিজের অনিষ্ট করে,ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে,তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।”[সূরা আন-নিসা; ৪:৯৭]
এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উলামারা উল্লেখ করেছেন কিছু মুসলমানের কথা, যারা দেশপ্রেম ত্যাগ করে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেনি। এদের মধ্যে ছিল আলী ইবন উমাইয়া ইবন খালাফ, আবূ কায়স ইবন ওয়ালিদ ইবন মুগীরা, আবু মনসুর ইবন হাজ্জাজ ও হারিস ইবন জাম‘আ। এরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু নিজেদের দেশ ও আত্মীয়-স্বজনের মায়া ছেড়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে হিজরত করে নি। শেষ পর্যন্ত এরা মুশরিকদের সে বাহিনীর সাথে মিলে বদরে এসেছিল যা মুসলমানদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যুদ্ধে এরা নিহত হলে মুসলমানরা বলাবলি করছিলেন " এদের কী হবে?", কারণ এরাতো মুসলমান ছিল। এরা যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রও ধারণ করেনি। কিন্তু মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত কোন তীর বা বর্শার আঘাতে অথবা কারো তরবারির বিক্ষিপ্ত আঘাতে এরা নিহত হয়। এরা যাদের সাথে ছিল তাদের সাথেই তাদের পরকালীন পরিণতি। এদের সম্পর্কে এবং বদরে বন্দী হওয়া কুরাইশদের পক্ষের লোকদের মধ্যেকার মুসলিম দাবীদারদের ব্যাপারেই এ আয়াত নাজ়িল হয়েছে। [তাফসীর ইবন কাসীর,[ড: মুজীবুর রহমান অনুদিত - ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ট ও ৭ম খণ্ড], সপ্তম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৩০-৫৩১; [২০০৭]। তাফসীর পাব্লিকেশন কমিটি, ঢাকা।]
মুসলিমরা দেশ ও গোষ্ঠি প্রেমে আবদ্ধ কোন জাতির [মিল্লাত/উম্মত] সদস্য নয়। দেশ-কাল নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করাই মু’মিনের জন্য জরুরী। আর হ্যাঁ! ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষার জন্য কাজ করা এবং তার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা এবং একে ভালবাসা নিশ্চয়ই ঈমানের দাবী। আর একাজের বিরাট পুরষ্কারের কথা বলেছেন রসূলুল্লাহ্ [সল্লা আল্লাহু আলায়হি ওয়া-সাল্লাম]। নীচের কয়েকটা হাদীস লক্ষ্য করুনঃ
সাহল ইবন সা‘দ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেয়া দুনিয়া ও দুনিয়ার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম। আর জান্নাতে তোমাদের কারো এক চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও তার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম। আর সাঁঝে আল্লাহর পথে বের হওয়া অথবা সকালে বের হওয়া দুনিয়া ও তার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম।” [বুখারী ও মুসলিম]
সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রসূলুল্লাহ্ [সল্লা-আল্লাহু আলায়িহি ওয়া-সাল্লাম] কে বলতে শুনেছিঃ একদিন ও একরাত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পাহারা দেয়া এক মাস ধরে রোজা রাখা ও রাতে ইবাদত করার চাইতে বেশী মূল্যবান। এ অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় তাহলে সে যে কাজ করে যাচ্ছিল মরার পরও তা তার জন্য জারী থাকবে, তার রিজিকও জারী থাকবে এবং কবরের পরীক্ষা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।” [সহীহ মুসলিম]
ফাদালা ইবন উবায়দ (রাঃ আঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ (সল্লা-আল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ মৃত্যুর পর প্রত্যেক মৃতের কর্মধারা শেষ করে দেয়া হয়। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পাহারা দেয় তার আমল ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাড়তে থাকবে এবং কবরের ফিতনা থেকেও সে নিরাপদ থাকবে।” [সুনান আত-তিরমিজ়ী]
এজন্য নিতান্তই মুসলমানদের হিফাজতের জন্য তাদের রাষ্ট্রের অনুগত থাকা ও তার প্রতিরক্ষার কাজ করা ঈমানেরই দাবী। মুসলিম এজন্য মুশরিকদের ওয়ালী [মিত্র/অভিভাবক] বানিয়ে অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেনা। যারা এধরণের কাজ করবে আল্লাহর কাছে তাদের কোন হুজ্জত থাকবেনা বরং নিজেদের বিরুদ্ধে তারা আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করবে তাদের এই কাজের মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ “হে ঈমানদারগণ মু’মিনদের বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করোনা। তোমরা কি চাও যে তোমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করতে?” [সূরা নিসা; ৪: ১৪৪]
মুখে মুখে দেশ প্রেমের যে কথন তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দেশপ্রেম, মানে নিজের চারপাশের ভূ-প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা ও একে ভালবাসা, মানব প্রকৃতিতে সহজাত একটা বিষয়। আর আল্লাহর জন্য প্রতিটা ভালবাসাকে কুরবানী দেয়াই হচ্ছে ঈমানের দাবী। ঈমানদারদের অবস্থা হচ্ছে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সব কিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসবে। আল্লাহ বলেছেনঃ
“আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা ঈমানদার তাদের ভালবাসা আল্লাহর প্রতি অনেক ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী।” [আল-বাক্বারা; ২:১৬৫]
ইমাম মুসলিম ও হাদীসের অন্যান্য সংকলকরা আব্বাস (রাঃ) ইবন আব্দুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি রসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছেন, “সে-ই ঈমানের সুমিষ্ট স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে যে আল্লাহকে রব্ব, ইসলামকে দীন এবং মুহাম্মদকে (সঃ) রসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে।”
ইমাম বুখারী ও মুসলিমের আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করা এক হাদীসের উদ্ধৃতি আমরা আগে পেশ করেছি যেখানে রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওআ সাল্লাম) বলেছেন, “তিনটি গুন এমন যার মাঝে ওগুলো বর্তমান সেই মূলতঃ ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে: (১) ঐ ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল জগতের সবকিছুর চেয়ে প্রিয়; (২) ঐ ব্যক্তি যে শুধু আল্লাহর ওআস্তে কাউকে ভালবাসে; এবং (৩) ঐ ব্যক্তি যে ঈমান থেকে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে তেমন ঘৃণা করে যেমন ঘৃণা করে সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।”
এ জন্য আল্লাহ [জাল্লা ওয়া ‘আলা] ও রসূলের (সল্লা-আল্লাহু আলায়হি ওয়া-সাল্লাম] প্রেমের স্বার্থে আর সব প্রেমের ক্বুরবানী করাই হল ঈমানের অঙ্গ। অবশ্য কোন ভূখণ্ডে যদি আমরা অবস্থান করি তবে সে ভূ-খণ্ডের মানুষের কল্যাণে কাজ করাও আমাদের ঈমানের দাবী। আর এ দাবীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের কাছে তৌহীদের বাণী পৌঁছে দেয়া।কারণ তৌহীদ গ্রহণেই রয়েছে তাদের অনন্ত কল্যাণ। মানুষের সবচেয়ে বড় অকল্যাণ হচ্ছে শিরকে নিমজ্জিত থাকা। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম [অবিচার]।” [সূরা লুক্বমান; ৩১:১৩]
এছাড়াও মানবতার কল্যাণে আরো যা যা করা দরকার তার সবই করা উচিৎ আমাদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যক্তিগতভাবে সৎ জীবন যাপন করা ও সমাজের অকল্যাণমূলক সব কাজ থেকে বিরত থাকা। চুরি, ডাকাতি, জনগণের ও সরকারী সম্পত্তি আত্মসাৎ, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, ঘুষ দান ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমাজ সমৃদ্ধশালী হয় এমন দিক নির্দেশনা দান এবং সামর্থ থাকলে সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ – যার মধ্যে রয়েছে অন্যায় ও দূর্নীতির অপসারণে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান - মানবতার কল্যাণের অন্যতম কাজ।
এজন্য দেশপ্রেমের চটকদার বুলির কোন অর্থ নেই একজন বিশ্বাসী মুসলিমের কাছে। আল্লাহর যথার্থ বান্দা হবার চেষ্টায় নিয়োজিত থেকে মানবতার কল্যাণের সংগ্রামে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের আকাংখাই হয় মুমিন জীবনের মিশন। এক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের দেশগুলোকে এবং বিশ্বাসী জনগোষ্ঠির জীবন ও সম্পদ রক্ষার সংগ্রামে আত্মদানের জন্য তৈরী থাকাও বিশ্বাসীদের ঈমানের দাবী – এটা শুধু নিজের জন্মভূমি বলে নয় বরং বিশ্বাসীদের ভূমি বলে; আর বাংলাদেশতো বিশ্বাসী মুসলিমদেরই ভূমি।
সব শেষের কথা হচ্ছে রসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে ভালবাসতেন এবং তিনি বলেছেন তাঁকে যদি বের করে দেয়া না হত তাহলে তিনি কখনোই বেরিয়ে যেতেন না। কিন্তু মক্কার প্রতি তাঁর এই ভালবাসা কি তাঁর জন্মভূমি বলে ছিল? না, এই ভালবাসা জন্মভূমির কারণে নয়। তিনি মক্কাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন কারণ মক্কা আল্লাহর জমীনগুলোর মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সে কথাও তিনি সুস্পষ্ট করে বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আদী ইবন হামরা আজ-জ়াহরী বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহকে [সঃ] মক্কার হাজ়ওয়ারায় দাঁড়াতে দেখেছি। তিনি বলেছেন, “[হে মক্কা], আল্লাহর কসম তুমি সারা পৃথিবীর সমস্ত জমিনগুলোর মধ্যে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে আল্লাহর জমিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়। আমাকে যদি তোমার ভেতর থেকে বের করে দেয়া না হত তাহলে আমি কখনোই বেরিয়ে যেতাম না।” [সুনান আত-তিরমিজ়ী –কিতাবুল মানাক্বিব – বাব ফাদলু মাক্কাহ।] অথচ আল্লাহর ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আল্লাহর এই প্রিয় শহর ছেড়ে তিনি (সঃ) নতুন এক শহরে বসতি স্থাপন করেছেন অনাত্মীয়দের মাঝে। এমনকি এ শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও তিনি ফিরে আসেন নি স্থায়ীভাবে আবার বসবাসের জন্য।
দেশপ্রেম সংক্রান্ত প্রকৃত কথা হচ্ছে এই বিষয়টা মানুষের সহজাত। মানুষ তার দেশকে ভালবাসে। যে জমিনে তার জন্ম হয়েছে, যে আকাশের নীচে সে বড় হয়েছে, যে আলো-বাতাসে সে বেড়ে উঠেছে সে মাটির প্রতি তার সহজাত মমত্ববোধ ও আকর্ষণ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। অনেকেই আবার এই দেশ - যা মূলত একটা ভৌগলিক পরিপার্শ্ব - এর সাথে রাষ্ট্রকে – যার সাথে সম্পর্ক হচ্ছে সরকার ও সার্বভৌমত্বের – তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এইজন্য কোন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধিতা করা অথবা রাষ্ট্রের উদ্ভবের বিরোধিতা মানে দেশপ্রেমহীনতা নয়।
যাইহোক, আসল কথায় আসা যাক। সেটা হল “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ” বলে বহুল প্রচলিত কথাটা রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) এর কথা নয়। রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) থেকে যা প্রমাণিত তা বরং এর বিপরীত। একজন ঈমানদারের কাছে কোন একটা ভূখণ্ডের বিশেষ কোন মর্যাদা নেই শুধু সেই ভূখণ্ড ছাড়া যাকে আল্লাহ তা‘আলা মর্যাদা দিয়েছেন। ঈমানের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে কুরবানী দেয়াই হচ্ছে ঈমানদারের কাছে তাঁর বিশ্বাসের দাবী। রসূলুল্লাহ (সলাওয়াতুল্লাহি ও সালামুহু আলায়হি) এর কাছ থেকে আমরা এমন বর্ণনাই বরং পাই।
সাবরা ইবন আবিল ফাকিহ (রাদিয়া আল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন, “আমি রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ নিশ্চয়ই শয়তান বনী আদমের প্রত্যেকটা পথের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সে তার ইসলাম গ্রহণের পথে ওঁৎ পেতে বসে এবং তাকে বলে, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে তোমার পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহের দীন ছেড়ে দিয়ে?’ কিন্তু সে শয়তানকে অমান্য করে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর সে [শয়তান] তার হিজরতের রাস্তায় ওঁৎ পেতে বসে এবং বলে, ‘তুমি নিজের জমিন ও আসমানকে [দেশপ্রেম] ত্যাগ করে হিজরত করবে?’ কিন্তু হিজরতকারীর অবস্থা হচ্ছে দীর্ঘ সফরে নিয়োজিত আরোহীর মত। সে তাকে [শয়তানকে] অমান্য করে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত সম্পন্ন করে। এরপর সে তার জিহাদের রাস্তায় ওঁৎ পাতে এবং তাকে বলে, ‘[তুমি জিহাদ করবে অথচ] এটা হচ্ছে জীবন ও সম্পদ ব্যয়ের সংগ্রাম; এতে তুমি লড়াই করবে ও নিহত হবে; এবং তোমার স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিয়ে দেয়া হবে ও তোমার সম্পদ ভাগ করে দেয়া হবে?’’’ তিনি (সঃ) বললেন, সে [মুজাহিদ] তাকে [শয়তান] অমান্য করবে এবং জিহাদ করবে। এরপর রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘যে এরূপ করেছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা সে যদি নিহত হয় তাহলে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা সে যদি ডুবে মারা যায় তাহলে আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; অথবা তার সওয়ারী জন্তু যদি তাকে ফেলে পদদলিত করে তাহলেও আল্লাহর উপর তার হক্ব এই যে তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।” [মুসনাদ ইমাম আহমদ – মুসনাদ আল-মাক্কিয়ীন]
যারা আল্লাহর রাস্তায় দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি তাদের জন্য আল্লাহর সামনে কোন হুজ্জত [দলীল/প্রমান] নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
“যারা নিজের অনিষ্ট করে,ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে,তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।”[সূরা আন-নিসা; ৪:৯৭]
এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উলামারা উল্লেখ করেছেন কিছু মুসলমানের কথা, যারা দেশপ্রেম ত্যাগ করে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেনি। এদের মধ্যে ছিল আলী ইবন উমাইয়া ইবন খালাফ, আবূ কায়স ইবন ওয়ালিদ ইবন মুগীরা, আবু মনসুর ইবন হাজ্জাজ ও হারিস ইবন জাম‘আ। এরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু নিজেদের দেশ ও আত্মীয়-স্বজনের মায়া ছেড়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে হিজরত করে নি। শেষ পর্যন্ত এরা মুশরিকদের সে বাহিনীর সাথে মিলে বদরে এসেছিল যা মুসলমানদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যুদ্ধে এরা নিহত হলে মুসলমানরা বলাবলি করছিলেন " এদের কী হবে?", কারণ এরাতো মুসলমান ছিল। এরা যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রও ধারণ করেনি। কিন্তু মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত কোন তীর বা বর্শার আঘাতে অথবা কারো তরবারির বিক্ষিপ্ত আঘাতে এরা নিহত হয়। এরা যাদের সাথে ছিল তাদের সাথেই তাদের পরকালীন পরিণতি। এদের সম্পর্কে এবং বদরে বন্দী হওয়া কুরাইশদের পক্ষের লোকদের মধ্যেকার মুসলিম দাবীদারদের ব্যাপারেই এ আয়াত নাজ়িল হয়েছে। [তাফসীর ইবন কাসীর,[ড: মুজীবুর রহমান অনুদিত - ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ট ও ৭ম খণ্ড], সপ্তম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৩০-৫৩১; [২০০৭]। তাফসীর পাব্লিকেশন কমিটি, ঢাকা।]
মুসলিমরা দেশ ও গোষ্ঠি প্রেমে আবদ্ধ কোন জাতির [মিল্লাত/উম্মত] সদস্য নয়। দেশ-কাল নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করাই মু’মিনের জন্য জরুরী। আর হ্যাঁ! ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষার জন্য কাজ করা এবং তার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা এবং একে ভালবাসা নিশ্চয়ই ঈমানের দাবী। আর একাজের বিরাট পুরষ্কারের কথা বলেছেন রসূলুল্লাহ্ [সল্লা আল্লাহু আলায়হি ওয়া-সাল্লাম]। নীচের কয়েকটা হাদীস লক্ষ্য করুনঃ
সাহল ইবন সা‘দ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেয়া দুনিয়া ও দুনিয়ার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম। আর জান্নাতে তোমাদের কারো এক চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও তার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম। আর সাঁঝে আল্লাহর পথে বের হওয়া অথবা সকালে বের হওয়া দুনিয়া ও তার উপরস্থ সব কিছু থেকে উত্তম।” [বুখারী ও মুসলিম]
সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রসূলুল্লাহ্ [সল্লা-আল্লাহু আলায়িহি ওয়া-সাল্লাম] কে বলতে শুনেছিঃ একদিন ও একরাত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পাহারা দেয়া এক মাস ধরে রোজা রাখা ও রাতে ইবাদত করার চাইতে বেশী মূল্যবান। এ অবস্থায় যদি কেউ মারা যায় তাহলে সে যে কাজ করে যাচ্ছিল মরার পরও তা তার জন্য জারী থাকবে, তার রিজিকও জারী থাকবে এবং কবরের পরীক্ষা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।” [সহীহ মুসলিম]
ফাদালা ইবন উবায়দ (রাঃ আঃ) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ (সল্লা-আল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ মৃত্যুর পর প্রত্যেক মৃতের কর্মধারা শেষ করে দেয়া হয়। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পাহারা দেয় তার আমল ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাড়তে থাকবে এবং কবরের ফিতনা থেকেও সে নিরাপদ থাকবে।” [সুনান আত-তিরমিজ়ী]
এজন্য নিতান্তই মুসলমানদের হিফাজতের জন্য তাদের রাষ্ট্রের অনুগত থাকা ও তার প্রতিরক্ষার কাজ করা ঈমানেরই দাবী। মুসলিম এজন্য মুশরিকদের ওয়ালী [মিত্র/অভিভাবক] বানিয়ে অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেনা। যারা এধরণের কাজ করবে আল্লাহর কাছে তাদের কোন হুজ্জত থাকবেনা বরং নিজেদের বিরুদ্ধে তারা আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করবে তাদের এই কাজের মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ “হে ঈমানদারগণ মু’মিনদের বাদ দিয়ে কাফিরদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করোনা। তোমরা কি চাও যে তোমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করতে?” [সূরা নিসা; ৪: ১৪৪]
মুখে মুখে দেশ প্রেমের যে কথন তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। দেশপ্রেম, মানে নিজের চারপাশের ভূ-প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা ও একে ভালবাসা, মানব প্রকৃতিতে সহজাত একটা বিষয়। আর আল্লাহর জন্য প্রতিটা ভালবাসাকে কুরবানী দেয়াই হচ্ছে ঈমানের দাবী। ঈমানদারদের অবস্থা হচ্ছে তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সব কিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসবে। আল্লাহ বলেছেনঃ
“আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা ঈমানদার তাদের ভালবাসা আল্লাহর প্রতি অনেক ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী।” [আল-বাক্বারা; ২:১৬৫]
ইমাম মুসলিম ও হাদীসের অন্যান্য সংকলকরা আব্বাস (রাঃ) ইবন আব্দুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি রসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছেন, “সে-ই ঈমানের সুমিষ্ট স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে যে আল্লাহকে রব্ব, ইসলামকে দীন এবং মুহাম্মদকে (সঃ) রসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে।”
ইমাম বুখারী ও মুসলিমের আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করা এক হাদীসের উদ্ধৃতি আমরা আগে পেশ করেছি যেখানে রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলায়হি ওআ সাল্লাম) বলেছেন, “তিনটি গুন এমন যার মাঝে ওগুলো বর্তমান সেই মূলতঃ ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে: (১) ঐ ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল জগতের সবকিছুর চেয়ে প্রিয়; (২) ঐ ব্যক্তি যে শুধু আল্লাহর ওআস্তে কাউকে ভালবাসে; এবং (৩) ঐ ব্যক্তি যে ঈমান থেকে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে তেমন ঘৃণা করে যেমন ঘৃণা করে সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।”
এ জন্য আল্লাহ [জাল্লা ওয়া ‘আলা] ও রসূলের (সল্লা-আল্লাহু আলায়হি ওয়া-সাল্লাম] প্রেমের স্বার্থে আর সব প্রেমের ক্বুরবানী করাই হল ঈমানের অঙ্গ। অবশ্য কোন ভূখণ্ডে যদি আমরা অবস্থান করি তবে সে ভূ-খণ্ডের মানুষের কল্যাণে কাজ করাও আমাদের ঈমানের দাবী। আর এ দাবীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের কাছে তৌহীদের বাণী পৌঁছে দেয়া।কারণ তৌহীদ গ্রহণেই রয়েছে তাদের অনন্ত কল্যাণ। মানুষের সবচেয়ে বড় অকল্যাণ হচ্ছে শিরকে নিমজ্জিত থাকা। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম [অবিচার]।” [সূরা লুক্বমান; ৩১:১৩]
এছাড়াও মানবতার কল্যাণে আরো যা যা করা দরকার তার সবই করা উচিৎ আমাদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যক্তিগতভাবে সৎ জীবন যাপন করা ও সমাজের অকল্যাণমূলক সব কাজ থেকে বিরত থাকা। চুরি, ডাকাতি, জনগণের ও সরকারী সম্পত্তি আত্মসাৎ, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, ঘুষ দান ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমাজ সমৃদ্ধশালী হয় এমন দিক নির্দেশনা দান এবং সামর্থ থাকলে সক্রিয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ – যার মধ্যে রয়েছে অন্যায় ও দূর্নীতির অপসারণে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান - মানবতার কল্যাণের অন্যতম কাজ।
এজন্য দেশপ্রেমের চটকদার বুলির কোন অর্থ নেই একজন বিশ্বাসী মুসলিমের কাছে। আল্লাহর যথার্থ বান্দা হবার চেষ্টায় নিয়োজিত থেকে মানবতার কল্যাণের সংগ্রামে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের আকাংখাই হয় মুমিন জীবনের মিশন। এক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের দেশগুলোকে এবং বিশ্বাসী জনগোষ্ঠির জীবন ও সম্পদ রক্ষার সংগ্রামে আত্মদানের জন্য তৈরী থাকাও বিশ্বাসীদের ঈমানের দাবী – এটা শুধু নিজের জন্মভূমি বলে নয় বরং বিশ্বাসীদের ভূমি বলে; আর বাংলাদেশতো বিশ্বাসী মুসলিমদেরই ভূমি।
সব শেষের কথা হচ্ছে রসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে ভালবাসতেন এবং তিনি বলেছেন তাঁকে যদি বের করে দেয়া না হত তাহলে তিনি কখনোই বেরিয়ে যেতেন না। কিন্তু মক্কার প্রতি তাঁর এই ভালবাসা কি তাঁর জন্মভূমি বলে ছিল? না, এই ভালবাসা জন্মভূমির কারণে নয়। তিনি মক্কাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন কারণ মক্কা আল্লাহর জমীনগুলোর মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সে কথাও তিনি সুস্পষ্ট করে বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আদী ইবন হামরা আজ-জ়াহরী বলেছেনঃ আমি রসূলুল্লাহকে [সঃ] মক্কার হাজ়ওয়ারায় দাঁড়াতে দেখেছি। তিনি বলেছেন, “[হে মক্কা], আল্লাহর কসম তুমি সারা পৃথিবীর সমস্ত জমিনগুলোর মধ্যে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে আল্লাহর জমিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়। আমাকে যদি তোমার ভেতর থেকে বের করে দেয়া না হত তাহলে আমি কখনোই বেরিয়ে যেতাম না।” [সুনান আত-তিরমিজ়ী –কিতাবুল মানাক্বিব – বাব ফাদলু মাক্কাহ।] অথচ আল্লাহর ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আল্লাহর এই প্রিয় শহর ছেড়ে তিনি (সঃ) নতুন এক শহরে বসতি স্থাপন করেছেন অনাত্মীয়দের মাঝে। এমনকি এ শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও তিনি ফিরে আসেন নি স্থায়ীভাবে আবার বসবাসের জন্য।
লেখককে ফলো করুন
|
© 2013 by Ask Islam Bangla.