ASK ISLAM BANGLA
  • Home
  • রচনাবলী
  • সাধারণ প্রশ্ন-উত্তর
  • ইসলামি সাধারণ জ্ঞান
  • ইসলাম বিরোধী প্রশ্নের জবাব
  • ইসলামের সেই কাহিনীগুলো
  • সাহাবীদের কাহিনী
  • গল্পে গল্পে শিখী
  • ROAD TO PEACE
  • Forum

ঐশী কথন ১ম পর্ব

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম  

কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানুহু তা’আলা বলেছেন:

"এটা মানুষের জন্য একটি সংবাদনামা।" [সুরা ইবরাহীম:৫২][১]

কুরআন মানুষের নিকট পৌছুনোর জন্য, মানুষের জন্য বার্তা। আল্লাহ্ তা’আলা  কুরআনকে বলেছেন যোগাযোগ কিংবা বার্তা আর যোগাযোগের রয়েছে কিছু অপরিহার্য উপাদান । প্রান্জলভাবে চিন্তা করলে আর উপলব্ধিতে সমর্থ হলে আমরা কুরআন ও আরবীর ভাষার এমন এক দিক উন্মোচনে, আস্বাদ গ্রহণে সমর্থ হবো; যা অধিকাংশ লোকজন যারা কুরআনের ছাত্র নন প্রতিনিয়ত হারাচ্ছেন। মূলতঃ এ সমস্যা সমগ্র মানবসমাজের ও। আর কুরআনের এমনই এক মাত্রা তুলে ধরার জন্য এই প্রচেষ্টা।

আমরা যখন যোগাযোগ স্থাপন করি সাধারনতঃ তিনটি উপাদানের কথা মাথায় রাখি। আর, যোগাযোগের তিনটি দিক রয়েছে। তার প্রথমটি হচ্ছে বক্তা। কোন ব্যক্তি যখন কথা বলার জন্য উপস্থিত হয় তখন তার উপস্থিতি, উচ্চতা, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি বাহ্যিকভাবে দেখে আমরা তার সম্পর্কে ধারনায় উপনীত হই; যদি ও আমরা তাকে বলতে শুনিনি। কিছুটা উপসংহারে আমরা পৌছায়; যে ঐ বক্তা কিভাবে কথা বলবে কিংবা কি বিষয়ে কথা বলবে ইত্যাদি। যদি এভাবে চিন্তা করি, কারো ছয় বছর বয়সী সন্তান তাকে তার ইনকাম ট্যাক্সের ব্যপারে চমৎকার উপদেশ দিলো যা সে ওইটুকু বাচ্চা থেকে প্রত্যাশা করেনি, সে কি তা গুরুত্বের সাথে নিবে? উত্তরঃ না। কিন্তু ওই একই উপদেশ যদি কোন আয়কর কর্মকর্তা দিতো তবে সে তা অধিক গুরুত্বসহকারে নিতো। এখানে ওই বাচ্চা থেকে উপদেশ গ্রহন না করার কারন হচ্ছে , তা এমন উৎস থেকে এসছে যা তার কাছে প্রত্যাশিত নয়। অথচ আয়কর উপদেষ্টার দেয়া উপদেশের তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এজন্য বক্তা যোগাযোগ স্থাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

এরচেয়ে আরো জীবন ঘনিষ্ঠ আর দ্বীন সম্পৃক্ত উদাহরণ দেই, আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে। আপনি মাসজিদে গেলেন কিন্তু একটু দেরিতে, ফলে আপনি মাসজিদের ভিতরে বসতে সমর্থ হলেন না অর্থাৎ বাইরে বসে খুতবা শুনছেন; এর ফলে আপনি খাতিবকে দেখতে পারছেন না।  আর খাতিব এমন এক ব্যক্তি যে জিন্‌স,  টি-শার্ট আর উল্টোভাবে ক্যাপ পরে আছে; খুব ভালমতো দাড়ি ও গজায় নি। কিন্তু সে এমন এক খুতবা দিলো যা আপনি জীবনেও শুনেন নি; এক কথায় মন্ত্রমুগ্ধকর।  অথচ, ভিতরে যে সকল লোক বসে আছে তারা ভাবছে, ‘এই লোকের পিছনে সলাত পড়লে আদৌ হবে কিনা?’ অন্যদিকে বাইরে বসে থাকা লোকেরা যারা তাকে দেখেনি, ভাবছে; ‘না জানি, এই শায়খ কোথায় পড়াশুনা করেছেন, তিনি কোথা হতে এসেছেন। খুতবাটা অসাধারণ ছিলো কিংবা এই শায়খের নাম কি? ইত্যাদি ইত্যাদি ’।  কিন্তু প্রশ্ন হলো কেনো?  কেননা, যিনি বক্তা তিনি নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলেন তার কথা শ্রোতা কিভাবে বুঝছেন তার উপর। যদি ও এটা মানবীয় ত্রুটি কিন্তু এটা বিদ্যমান। এ ব্যপারটি কুর’আনের ক্ষেত্রেও কি  প্রযোজ্য? হ্যা অবশ্যই! আমরা যতই এগোব, কুর’আনের ক্ষেত্রেও আপনি এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবেন।

লোকজন যখন কুরআন শুনেছে তারা এর দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছে, তারা তার ভালবাসায় পড়েছে আর তা তাদের জীবনে নিয়ে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এটা তাদের এতটাই প্রভাবান্বিত করতে সমর্থ হয়েছে। অপরদিকে, কিছু লোক যারা এই কিতাবের প্রতি চরম বিদ্বেষী হয়েছে। তাদের বিদ্বেষ এতোটাই গভীর যে তারা ইচ্ছা পোষণ করে, যাতে এই কিতাব অন্য কারো নিকট না পৌঁছুক।

এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখা যায় – কোন ধরনের নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া নয়! এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে কুর’আন শুনে বলে, ‘হুম! এটা কৌতূহলের সৃষ্টি করে’। কেবল দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যায়।

এখন, আপনাকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে, ‘কে বলছে’ এই উপাদানটির সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দিই।  আল্লাহ্‌ তা’আলা কুর’আনে বলেছেনঃ

‘আল্লাহ্‌  উপমা/ উদাহরণ দিয়েছেন ... ‘  [সুরা তাহরীমঃ ১১] [২]

 খেয়াল করুন, এখানে উদাহরণ কে দিয়েছেন? আল্লাহ্‌।

সুতরাং এখানে বক্তা কে? আল্লাহ্‌ - আর এই বিষয়টি সুস্পষ্ট। আমি যদি বলি, ‘আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি’, আপনি হয়তো বলবেন, ‘ভালো উদাহরণ’ কিন্তু যদি বলি, ‘আল্লাহ্‌ একটি উদাহরণ দিয়েছেন’ – আপনি যদি বিশ্বাসী হন, তবে এই কথাটি অধিক গুরুত্ব সহকারে নিবেন; অবশ্যই নিবেন। এখানে আপনি কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। বক্তা – আল্লাহ্‌ সুবহানুহু তা’আলাকে। কিন্তু অপরদিকে, একজন অবিশ্বাসীর কথা চিন্তা করুন, যাকে রাসুলুল্লাহ ওই একই কুর’আন শুনাচ্ছেন মক্কায়; তাকে যদি বলা হয় ‘আল্লাহ্‌ একটি উদাহরণ দিয়েছেন’ তবে সে কানে হাত গুজে চলে যাবে। সে বলে উঠে, ‘আমি আল্লাহ্‌ কি বলে তা শুনতে চাই না, অনেক শুনেছি, গত এক দশক ধরে এসব বলছ; আর শুনতে চাই না’,  ইত্যাদি। সে একমাত্র একটি কারনে এই উদাহরণ শুনতে চায় না; আর তা হচ্ছেঃ বক্তা।    

ঠিক যে কারনে বিশ্বাসীরা অধিক মনযোগ দেয়, ওই একই কারনে অবিশ্বাসীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই ব্যপারটি নিঃসন্দেহে আপনি খেয়াল করেছেন। যেমন ধরুনঃ মাদানী সুরা, সুরা আত-তাহরীমে, ‘আল্লাহ্‌ একটি উদাহরণ দিয়েছেন’, মাদানী সুরা বাকারাহয়, ‘আল্লাহ্‌ একটি উদাহরণ দিয়েছেন’ ইত্যাদি।

কিন্তু, যখন আপনি দেখবেন সুরা হাজ্জের মত মাক্কী সুরায়; যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াত দিচ্ছেন এমন লোকদের যাদের অধিকাংশই আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেনি। আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি বলছেন এভাবে, ‘হে লোকসকল শোন! একটি উদাহরণ দেয়া হল।’ কাকে সরিয়ে নেয়া হল এই বক্তব্য থেকে? বক্তাকে! আল্লাহ্‌ এখানে বলেন নি, ‘আল্লাহ্‌ একটি উদাহরণ দিয়েছেন’ ; বরং তিনি বলেছেন, ‘একটি উদাহরণ দেয়া হল’। তিনি এখানে বক্তাকে উহ্য রেখেছেন; কেননাঃ যখন অবিশ্বসীরা শুনে যে বক্তা হলেন আল্লাহ্‌ তা’আলা তখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে বাকী বক্তব্য তাদের কাছে অসার। তাই আল্লাহ্‌ তা’আলা এখানে বক্তাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন বক্তব্যকে। আর এটাই যোগাযোগের দ্বিতীয় উপাদানঃ অর্থ্যাৎ যা বলা হল, বক্তব্য; সোজা কথায় আধেয়/মূলকথা।

এই পর্যন্ত দু’টি বিষয়ের কথা বলা হলঃ বক্তা এবং বক্তব্য। সুতরাং যখন আল্লাহ্‌ বলছেন, ‘একটি উদাহরণ দেয়া হল’, এখানে কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হল? বক্তব্যকে। অর্থাৎ উদাহরনের দিকে মনোনিবেশ কর, উৎসের দিকে নয়। অর্থাৎ, বক্তব্যের বিচার কর। সুতরাং, এখানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এই বিষয়টি কুর’আনে খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। এখানে কেবল একটি উদাহরণ দেয়া হল। কুর’আন তার পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্নভাবে সচেতন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি কৌতূহলউদ্দীপক মন্তব্য করেছিলেন, তিনি বলেনঃ “আমরা বক্তব্যকে মূল্যায়ন করি, বক্তাকে নয় ”। অর্থাৎ, আমরা কে বলল তা জানার আগে, কি বলা হল তা বিচার করি। কেননা হতে পারে, এমন এক উৎস থেকে আপনি সত্য উদঘাটন করতে সমর্থ হবেন, যা আপনি কখনো কল্পনা করেন নি।

আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত বর্জনের অন্যতম কারন হল তিনি ছিলেন ইয়াতিম, তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ ছিলেন না কিংবা তিনি দুই শহরের [মক্কা ও তায়েফ] বিখ্যাত দুই নেতার একজন ছিলেন না; যাদেরকে তারা সমীহ করতো। আর কাফিররা প্রায়ই এ অভিযোগ করতো, সে কে আমাদের বলার কিংবা আমরা কেন তার কথা শুনব? আর এই বিষয়টি কুর’আনে ও এসেছেঃ 

“তারা বলে, কোরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হল না?” [সুরা যুখরুফঃ ৩১]  [৩]  

অর্থাৎ ওই দুই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বেছে না নিয়ে কেন তাকে বেছে নেয়া হল?

এখন পর্যন্ত যোগাযোগের দুটি উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ বক্তা আর বক্তব্য।   

এবার, তৃতীয় উপাদান – কিভাবে তা বলা হল? অর্থাৎ, বক্তা, বক্তব্য এবং কিভাবে তা উপস্থাপন করা হল বা বলা হল। যদি কাউকে উপদেশ দেয়া হয়, “ভালভাবে পড়াশুনা কর ”; অর্থাৎ কারো সামনেই পরীক্ষা, তার মা এসে তাকে বলল, “তুমি কোন কাজের না! তুমি সময় নষ্ট করছ, তোমার অবস্থা খুবই করুণ! ” এসব বলার পর বলল, “পড়”। নিঃসন্দেহে ঐ মা ভালো উপদেশ দিতে এসেছিলেন কিন্তু তিনি যেভাবে উপদেশ দিলেন; তার বলার ধরন ঐ উপদেশকে অকার্যকর করে দিলো। তাই আপনার কাছে কেবল বক্তা আর বক্তব্য থাকলেই চলবে না; বরং আপনি কিভাবে তা উপস্থাপন করছেন তাও কার্যকরী হওয়া চাই। অন্যথায়, আপনি আপনার বক্তব্যের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবেন। সাথে সাথে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ও। যোগাযোগের অন্যতম উদ্দেশ্য হল শ্রোতাকে প্রভাবান্বিত করা; শুধুমাত্র তাদেরকে কিছু শুনানো নয় কিংবা কিছু দেখানো নয় বরং প্রভাবান্বিত করে তাদের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসা। আর আপনি এটা কখনো করতে সমর্থ হবেন না যদি আপনি যথার্থভাবে/ কার্যকরভাবে তা বলতে সমর্থ না হন; যদি ও আপনি ভালো কিছু বলতে চান।

আপনাকে আরো একটি উদাহরণ দেইঃ আপনি একটি খুতবা শুনলেন যার বক্তব্যের বিষয়বস্তু এক কথায় চমৎকার; কিন্তু যেভাবে আপনার সামনে তা উপস্থাপন করা হল, তা খুবই একঘেঁয়ে অথচ তার বিষয়বস্তু বলিষ্ট। তাতে রয়েছে পর্যাপ্ত কুর’আনের আয়াত, পর্যাপ্ত হাদিসের উল্লেখ, অনেক চমৎকার উদ্ধৃতি কিন্তু যেভাবে তা বর্ণনা করা হল তা খুবই পানসে; ফলে আপনি দেখবেন, অর্ধেক শ্রোতাই আগ্রহ হারিয়ে বসে আছে। এখানে সমস্যা বিষয়বস্তু নিয়ে নয়; বিষয়বস্তু তো ঐশী! কিংবা হতে পারে বক্তাকে নিয়ে ও কোন সমস্যা নাই কিন্তু এখানে সমস্যা কি?  বলার ধরন, অভিব্যক্তি – কিভাবে তা তুলে ধরা হল।

আমরা অর্থবহ যোগাযোগের তিনটি উপাদানের সাথেই পরিচিত হলামঃ বক্তা, বক্তব্য আর বলার ধরন। আর মিডিয়ার পড়াশুনায় এই বিষয়টিই সবার আগে শিখানো হয়, মাধ্যমই হচ্ছে বার্তা। অর্থাৎ আপনি যে উপায়ে তা পরিবেশন করছেন তারচেয়ে কিভাবে তা পরিবেশন করছেন তার গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়।  

সুতরাং, এই সকল মৌলিক পরিচিতি দ্বারা আমরা কুর’আনের দিকে ফিরে যাই আর নিজেদের জিজ্ঞেস করি। আমরা বিশ্বাস করি কুর’আন অলৌকিক। আমরা বিশ্বাস করি কুর’আন অনন্যসাধারন, কুর’আন তার সৌন্দর্যে অনন্য। আমরা বিশ্বাস করি , কুর’আন বার্তা হিসেবে অসাধারন ।

কিন্তু কুর’আন আরো তিনভাবে অসাধারনঃ এটা অসাধারণ, কারন এর বক্তা অসাধারণ। কুর’আন অসাধারন, কারন এর বক্তব্য/ভাষ্য অসাধারন। কুর’আন অসাধারন, কারন এর বলার ধরন অসাধারন। অর্থাৎ, এই তিনভাবেই কুর’আন অসাধারন।      

এবার, আমরা একটু মনোযোগ দেই, বক্তার দিকে। কুর’আনে বক্তা কে? আল্লাহ্‌ সুবহানুহ ওয়া তা’আলা। এবার একটু ভাবুন, অবিশ্বাসীরা; যাদের রাসুলুল্লাহ কুর’আন শুনাচ্ছিলেন, তারা বিশ্বাস করতো না এই কুর’আন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। তারা কাকে বক্তা ভাবতো? মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে। অন্যদিকে বিশ্বাসীরা জানত এইসব বাণী আল্লাহর; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কেবল একজন বার্তাবাহক। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কেবল আল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করছেন। অপরদিকে, অবিশ্বাসীদের ভাষ্য ভিন্ন; তারা যদি বিশ্বাসই করতো যে এই বাণী আল্লাহর তবে তো তারা মুসলিমই হয়ে যেতো!

এবার, আমরা অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিকোণ। তাদের ভাষ্যমতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই বক্তা। এই বিষয়টি মাথায় রাখুন – খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন, আল্লাহ্‌ বলেছেন, এই বার্তা কেবল বিশ্বাসীদের জন্য নয় বরং মানবসকলের জন্য। আর, এই আয়াত দিয়েই আমরা শুরু করেছিলাম। অথচ মক্কার অধিকাংশ লোকজনই একে আল্লাহর কিতাব নয় বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বাণী মনে করতো। এরপর ও কুর’আন অলৌকিক। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, তিনি কখনো এর বক্তা হতে পারেন না। আর, যদি তাকে বক্তা হিসেবে ধরা হয়, তবু ও এই উপলব্ধি আসবে যে, অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে! কেননা, কুর’আনে রয়েছে বণী ইসরাইলের ইতিহাসের বর্ণনা।  

আপনাদের সামনে এবার অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করব; যদিও তা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উপর যখন ওয়াহি নাযিল হচ্ছিলো, তখন তিনি এমন তথ্য দেয়া শুরু করেছিলেন যা কেবল আহলে কিতাবদের বিশুদ্ধ কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল। যদি ও আহলে কিতাবদের তখনকার দিনের বাইবেলের পড়াশুনা কেবল ধর্মযাজকদের/ পাদ্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর তখনকার খ্রিস্টানদের অধিকাংশই বাইবেল পড়তে জানতো না; কারো কিছু জানার থাকলে তাকে যেতে হত পাদ্রীর কাছে। বাইবেলের জন্য ছিল পাদ্রী আর তাওরাতের জন্য ছিল রাবাই। এই পড়াশুনা এতই বেশী সীমাবদ্ধ ছিল যে, যেমনটা কোন দেশের সংবিধানের ব্যখ্যা; যার জন্য যেতে হয় একজন আইনজীবীর কাছে। অর্থাৎ, অভিজ্ঞ কারো শরনাপন্ন হওয়া; যার ঐ বিষয়ের উপর দখল আছে। অথচ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এমন সব খবর দিচ্ছিলেন যা কেবল তাদের উচ্চমার্গীয় জ্ঞানীদেরই জানার কথা। তাই, তারা বুঝতে সমর্থ হয়েছিল যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিজে বক্তা নন।

এই প্রেক্ষিতে আপনাদের একটি বিষয় বলতে চাই, আর তা হলঃ কুর’আনের ঐতিহাসিক বিশুদ্ধতা।

হামান। আপনি জানেন হামান কে? সে একজন মন্ত্রী ছিল; ফিরাউনের মন্ত্রিপরিষদের। হামানের কথা কুর’আনে এসেছে মোট ছয় বার। আল্লাহ্‌ তা’আলা কুর’আনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন যে, ফিরাউন হামানকে নির্দেশ দিয়েছিলো একটি উচু প্রাসাদ নির্মাণ করার জন্য। অনুরূপভাবে, হামানের বর্ণনা পাওয়া যায়, বাইবেলে ও। আর এখানে ও বর্ণনা আছে প্রাসাদ নির্মাণ করার; কিন্তু এখানে হামানের বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে জারজিস নামের এক রাজার মন্ত্রী হিসেবে। এটা আছে বাইবেলের বুক অফ এস্টারে। আর এটা নিয়েই ষোড়শ শতকের বাইবেল পণ্ডিতগন; যারা ওরিয়েন্টালিস্ট হিসেবে পরিচিত, শোরগোল ফেলে দিলো এই বলে যে ‘আমরা কুর’আনে ভুল খুঁজে পেয়েছি’। তারা বলল যে, ফিরাউন নয় বরং রাজা জারজিসের অধীনে কাজ করেছিল হামান তাও আবার ব্যবিলনে; ফিরাউনের ১০০০ বছর পর। যদি ও আমরা কখনো ব্যবিলনের প্রাসাদের কথা শুনিনি। আর এই সুত্র ধরে তারা কুর’আন ঐতিহাসিক বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল (আল্লাহর নিকট পানাহ চাই)। তারা অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিকোন থেকে বলা শুরু করল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সকল তথ্য খ্রিস্টান পাদ্রী আর ইয়াহুদি পণ্ডিতদের কাছ থেকে নিয়েছে আর ফিরাউন ও হামানের ঘটনার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ তাদের ভাষ্যমতে কুর’আনে ভুল  উদ্ধৃতি রয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যপার হচ্ছে, ১৮শ শতকে খ্রিস্টান ক্যথলিক বৃত্তি প্রদানকারীরাই বুক অফ এস্টারের ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই বলে ঘোষনা দিয়েছে। তারা নিজেরাই আরো স্বীকারোক্তি দিয়েছে তাদের এই বই কেবলই কিংবদন্তি; বানানো গল্প আর বানানো নামে ভরপুর। আর ইহুদি এনসাইক্লপিডিয়ায় আপনি এখনো পাবেন যে বুক অফ এস্টারের কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, কুর’আন বনী ইসরাইল সম্পর্কে এমন তথ্যও প্রদান করছিলো যাতে তারাও মতপার্থক্য করেছিলো। অর্থাৎ কুর’আনের এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার সাথে তারা একমত ছিল না। সুতরাং যিনি কথা বলছিলেন [মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম] অর্থাৎ এসব তথ্য দিচ্ছিলেন তিনি কখনো বক্তা হতে পারেন না; এই জ্ঞানের উৎস ভিন্ন। 

  এবার শুনুন, আপনারা অনেকেই মরিস বুকাইলির নাম শুনে থাকবেন; তিনি তার ‘বাইবেল, কুর’আন আর বিজ্ঞান’ বইয়ের জন্য পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন ঐতিহাসিক এবং ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনার আগ্রহ জন্মেছিল তার মাঝে। যখন খ্রিস্টান পাদ্রিদের দ্বারা তিনি হামানের নামের ব্যপারে সমস্যার কথা শুনলেন; তিনি গবেষণায় লেগে গেলেন। আর আঠারো শতকের শেষের দিকে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিককে ভাষা হিসেবে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছিল। যেহেতু, ভাষা হিসেবে হায়ারোগ্লিফিক দুই হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল, অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামেরও অনেক পূর্বে এই ভাষা বিলুপ্তি লাভ করেছিল। ভাষা হিসেবে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক ছিল মৃত; যা পরবর্তীতে জার্মান আর ফরাসি পণ্ডিতেরা উদ্ধার করেছিল। আর এই পড়াশুনার নাম ছিল ‘ইজিপ্টোলজি’। আর এই পড়াশুনার জন্য তারা মিশরে গিয়ে হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে গবেষণা করে এমন একটা পদ্ধতি বের করেছিল যা দ্ধারা ঐ চিত্রগুলো পড়া যায়, উচ্চারন করা যায় ইত্যাদি। আর এটা আজ থেকে একশ বিশ কিংবা একশ তিরিশ বছর আগে  শুরু হয়েছিল। তারা গবেষণার পর এইসব গবেষণাকে লিপিবদ্ধ করেছিল। আর তারা এই চিত্রকর্মে বর্ণিত বিভিন্ন মন্ত্রী আর তাদের দায়িত্ব/ ভুমিকা কি ছিল তাও লিপি্বদ্ধ করেছিল। মরিস বুকাইলি ফ্রান্সে একজন ইজিপ্টোলজিস্টের কাছে গেলেন আর তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আপনাদের লিপিবদ্ধ নথিপত্রে হামান নামের কেউ আছে কিনা?’ তখন সে বলল, ‘আমি আপনাকে সাহায্য করেতে পারছি না, আপনাকে জার্মানি যেতে হবে কিন্তু আপনি হামান নামটি কোথায় পেয়েছেন?’ সে [মরিস] বললঃ ‘একজন সপ্তম শতকের একজন যে নিজেকে নবী বলে দাবী করেছিল, তিনিই বলেছেন যে ফিরাউনের একজন মন্ত্রী ছিল হামান; যাকে সে প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেছিল।’ সে বললঃ ‘এটা অসম্ভব’। কেননা, ঐ সময়ে এই নাম কারো জানার কথা না, যেহেতু ভাষাটি আর ও দুই হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিল। মরিস জার্মানি গেলেন আর বিভিন্ন স্থপতি-নির্মাণকারী আর মন্ত্রীর নাম খুজতে লাগলেন; বিশেষ করে মুসা আলায়হি আস-সালামের সময়কালের ফিরাউনের সভাসদদের। সে কি খুঁজে পেল? সে খুঁজে পেল হামান; পাথর খোদাইয়ের মন্ত্রী। এই নামটি আবিষ্কৃত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতে। আর অস্ট্রিয়াতে হামান নামের একটা মূর্তিও আছে। আর এই নামটি তারা পেয়েছে মিশর থেকে। হামানের নামও আছে পদবিও আছে। কিন্তু এই তথ্য না বাইবেলে ছিল না তাদের কাছে ছিল। বরং তা ছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছে। এতেই বুঝা যায়, এর বক্তা তিনি নন বরং আল্লাহ্‌ সুবহানুহ তা’আলা। আর এটা তো কেবল একটা ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ; যা নিয়ে খ্রিস্টানরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো অথচ তা তাদের দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। সুবহান’আল্লাহ!    

এ তো গেল, কুর’আনের একটি দিক। আপনাদেরকে কুর’আনের যে দিকটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছি তা এর বক্তা কিংবা বক্তব্য নয়। কুর’আনে আল্লাহ্‌ কি বলেছেন তা নয় বরং বলার ধরন/ তা কিভাবে বলা হয়েছে তাই মূখ্য। যে বৈশিষ্ট্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কুর’আনকে অন্য সবকিছু থেকে পৃথক করে; তা হল আল্লাহ্‌ তা’আলার অনন্য শক্তিশালী আর অসাধারন বলার ধরন। যখন, কুর’আনের অনুবাদ করা হয় তখন আপনি কেবল সরল বার্তা পেতে পারেন কিন্তু কিভাবে তা বলা হল তা শতভাগ হারাবেন। অর্থাৎ, কি বলল তা জানতে পারবেন কিন্তু কিভাবে বলা হল তা কখনোই জানতে পারবেন না। কেননা, কিভাবে তা বলা হল তা কেবল আরবী ভাষায় জানতে পারবেন। এমন কি কেউ যদি অন্য কাউকে আরবিতে ব্যাখ্যা করে ও বুঝায় তবুও তা হবে তার বোধগম্য ব্যখ্যা। তাই, কুর’আনের সৃজনশীল- অদ্বিতীয় সৌন্দর্য আর অতুলনীয় বর্ণনারীতি কখনো অনুবাদযোগ্য নয়।

কুর’আনের অর্থের কিছুটা তার অনুবাদে আসতে পারে; কিন্তু কুর’আনের যে সত্যিকার প্রভাব তা কখনো উপস্থিত থাকবে না। আর এটাই আমাদের অনুবাদের সাথে আল্লাহর বানীর দূরত্ব। ইমাম সুয়ুতি রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘আপনি যদি আল্লাহ্‌ এবং তার সৃষ্টির মাঝে যে দূরত্ব তা উপলব্ধি করতে পারেন, অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তার সৃষ্টির কত ঊর্ধ্বে; তাহলে আপনি কিছুটা ধারনা করতে পারবেন আল্লাহর বাণী [কুরআন] আর সৃষ্টির কথার [অনুবাদ] মাঝে পার্থক্যের’।



[১] هَٰذَا بَلَاغٌ لِّلنَّاس

[২] وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا’

[৩] وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ


পর্ব ২
লেখককে ফলো করুন
site search by freefind advanced

© 2014 by Ask Islam Bangla.
Powered by Create your own unique website with customizable templates.