ইরাকঃ ইমাম মাহদির হাতে বাইয়াত ও যুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে হাদিস ও সেখানে দাজ্জালি এডভান্স ফোর্সের বর্তমান কার্যক্রম
যেহেতু বৃহত্তর ইরাকের একটি দল ইমাম মাহদির সঙ্গী হবে এবং ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে ও পরে বিভিন্ন ঘটনা ও যুদ্ধের সাথে এই ভূখণ্ডের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা এসেছে, তাতে বুঝা যায় যে, এগুলো শেষ জামানার অংশ হিসাবে হতে হবে। আসুন, আমরা একটু মিলিয়ে নেই, হাদিসের ধারাবাহিকতায় আমরা কোন জামানায় বসবাস করছি। অন্যথায়, বৃহত্তর ইরাকে থেকে যে দলই বের হোক না কেন আর যত ঘটনা ও যুদ্ধই হোক না কেন, তার গুরুত্ব অনুধাবন করা যাবে না।
হযরত হুজায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“নবুওয়াত ব্যবস্থা তোমাদের মাঝে ততদিন থাকবে, যতদিন আল্লাহ তাআলা মঞ্জুর করেন। অতঃপর যখন ইচ্ছা, তখন তিনি তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর) তোমাদের মাঝে নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে এবং তা আল্লাহ তাআলা যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে (খুলাফায়ে রাশিদিন এর যুগ)। অতঃপর তিনি তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর হানাহানির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা আল্লাহ তাআলার যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে (রাজতন্ত্র)। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তার বিলুপ্তি ঘটবে। তারপর জবর দখল তথা আধিপত্য বিস্তারের রাজত্ব কায়েম হবে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় দুনিয়াতে কিছুকাল বিরাজমান থাকবে (নানা ভূখণ্ডে বর্তমান একনায়কতন্ত্র ও রকমারি বাদ ও তন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত স্বৈর শাসকগণ) । তারপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, তখন এরও অবসান ঘটবে। অতঃপর নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কায়েম হবে। এ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ রইলেন”।(মুসনাদে আহমদঃ ৪/২৭৩)
আর তাছাড়া অপর হাদিসে, হযরত আবু উবাইদা (রাঃ) এবং মু’আজ বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ইসলামের সূচনা হয়েছে নবুওয়াত ও রহমতের শাসনের মাধ্যমে। এরপর হবে খেলাফত ও রহমতের শাসন। এরপর হবে অত্যাচার লুটেরা বাদশাদের শাসন। এরপর হবে অহংকারী প্রভাবশালী বাদশাদের শাসন, তখন জমিনে অন্যায়, অবিচার, ফেতনা ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়বে। সেকালের লোকেরা রেশম (সিল্ক), ব্যভিচার (পরকীয়ার পাশাপাশি বয়ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ডের নামে চলমান বহুল প্রচলিত সামাজিকভাবে স্বীকৃত উঠতি বয়সী অবিবাহিতদের জেনা) এবং মদকে হালাল করে ফেলবে। আল্লাহর সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত এর মাধ্যমেই তাদেরকে রিজিক দেওয়া হবে এবং সাহায্য করা হবে”।(শুয়াইবুল ঈমান আল বায়হাকি, ৫/১৬)
উপরের হাদিসদ্বয়ের প্রেক্ষিতে আমরা যে যুগের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি, তা হচ্ছে অন্যায়, অবিচার ও ফেতনা ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়ার যুগ। আল্লাহ তা’আলার জমিনে সর্বোচ্চ শাসন ব্যাবস্থা (sovereignty) একমাত্র আল্লাহর হওয়া উচিৎ। যদি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর কানুন ব্যতীত মানুষের তৈরি কোন কানুন বাস্তবায়নের অপচেস্টা চালানো হয়, তবে অবশ্যই জমিনে অন্যায় অবিচার ও ফেতনা ফ্যাসাদে ভরে যাবে।
১৯২৪ সালে উসমানি খেলাফতের ভেঙ্গে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আজ ৫৭ টি ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে বর্তমানে একনায়কতন্ত্র ও রকমারি বাদ ও তন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত স্বৈর শাসকদের দ্বারা শাসিত। ‘অতঃপর নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে’ - মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তিই প্রমাণ করে সারা বিশ্বে ইসলামী শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে। রাজত্বের লাগাম মুসলিমদের হস্তগত হবে। কখনো এর ব্যতিক্রম হবে না। কারণ, বিভিন্ন বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা যথা সময়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে। এবং আমরা সেই রকমই একটি ‘ট্রাঞ্জিকশন ফেজ’ এ আছি।
মূলত রাসুল (সাঃ) এর যুগে বৃহত্তর ইরাক বলতে এর সীমানা বর্তমান ইরাক ও কুয়েতকে বুঝায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার (ইরাকের পূর্ব নাম) অংশ হিসাবে বর্তমান কুয়েতের ইতিহাস পাওয়া যায়। বৃহত্তর ইরাকে ইসলাম আসার পরের ইতিহাসে দেখা যায়, কুয়েত ছিল বসরা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি অংশ যা কিনা বন্দরনগরী হিসাবে বানিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বপ্রথম ১৭৫৭ সালে সাবাহ বিন জাবিরকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের জন্য আমির নিজুক্তির মধ্য দিয়ে “আল সাবাহ” রাজ পরিবারের সূচনা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তুর্কি (তুরস্ক) সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেখানকার তৎকালীন আমীর কুবারক আল সাবাহ তার দুই ভাইকে হত্যা করে তুর্কি (তুরস্ক) সাম্রাজ্যাধীন ইসলামিক খেলাফতের অংশ না হতে চেয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে নিরাপত্তা দানকারী বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাদের সাথে ১৮৯৯ সালে একটি ‘নিরাপত্তা চুক্তি’ সম্পাদন করে। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালের “অ্যাংলো অটোম্যান কনভেনশন” চুক্তির মাধ্যমে তুর্কি (তুরস্ক) সাম্রাজ্য হতে বের হয়ে এসে ব্রিটিশদের ছায়াতলে বছরের পর বছর থাকার পরে ১৯৬১ সালে একটি সতন্ত্র ভূখণ্ড হিসাবে একটি রঙ্গিন জাতীয়তাবাদের পতাকা বাগিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে ইরাক অতীত ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে কুয়েতকে নিজেদের অংশ হিসাবে দাবী করলেও ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে একটি স্বাধীন ও সতন্ত্র ভূখণ্ড হিসাবে কুয়েতকে মেনে নেয়।
তৎকালীন সময়ে কুফা, বসরা ও বাগদাদ (পূর্ব নাম ‘জাওরা’) ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে ভূখণ্ডের অন্যান্য এলাকাগুলোতে লোকালয় গড়ে উঠেছে। হাদিসের কখনও শুধু ইরাক এসেছে। কখনও সরাসরি কুফা, বসরা ও বাগদাদের কথা এসেছে। কখনও বা দজলা ও ফোরাত নদীর উপকুলের কথা বা সেখানে অবস্থিত অঞ্চলের নাম সরাসরি এসেছে। যাহোক, আমরা সতর্কতার জন্য বর্তমান ইরাক ও কুয়েতকেই বৃহত্তর ইরাক হিসাবে মাথায় রাখবো।
আসুন, প্রথমে আমরা বৃহত্তর ইরাকের অন্যতম অংশ কুয়েত সম্পর্কে একটি অবাক করা বর্ণনা জেনে নেই যা ইমাম মাহদি বিষয়ক একটি গ্রন্থে। বর্ণনাটি নিম্নরূপঃ
“মেরুদণ্ডের সর্বশেষ হাড়ের চেয়েও ছোট হাড়ের ন্যায় একটি ভূখণ্ড যুদ্ধের কারণ হবে। সারা বিশ্ব তার জন্য এমনভাবে একত্র হবে যেন সেই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভূখণ্ড আর তাকে পাওয়ার জন্য সারা বিশ্ব এক হয়েছে। সেই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের শাসক পৃথিবীর সকল ফিতনা সৃষ্টিকারী শাসকদের নেতার কাছে তার পতাকাকে সমর্পণ করবে, যে (ফিতনা সৃষ্টিকারী শাসকদের নেতা) কিনা সর্ব পশ্চিমের সুদূরবর্তী সমুদ্র উপকূলবর্তী ভূখণ্ড থেকে আসবে। আর তখন এটাই হবে শেষের (শেষ জামানার) শুরু যেহেতু সে (ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের শাসক) গোটা বিশ্বের কাছে তার (ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের) সাহায্যের জন্য আর্জি জানাবে। সে (ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের শাসক) আবার তার সিংহাসন ফিরে পাবে আর এর মোকাবিলায় ইরাকের শেষ জামানা সম্পর্কিত ধ্বংস শুরু হবে। ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের সেই শাসক ইমাম মাহদির সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং সেই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড আবার হুমকির সম্মুখীন হবে যেহেতু এর শাসক অনেক ফেতনার কারণ। ইমাম মাহদি এই (ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের) শাসককে হত্যার নির্দেশ দিবে এবং সেই ক্ষুদ্র হাড়টি (ক্ষুদ্র ভূখণ্ড) মূল শরীরে (মূল ভূখণ্ডে) ফেরত আসবে”।(আসমাল মাসালিক লিয়্যাম মাহাদিয়্যা মালিকি লি কুল্লু-ইদ দুনিয়া বি ইম্রিল্লাহিল মালিক, লেখকঃ কালদা বিন জায়েদ বিন বারাকা)
১৯৯০ সালের ২ রা আগস্ট ইরাক কুয়েত (তাছাড়া কুয়েতি দিনার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান নোট) দখল করে নেয় এবং ১৯ তম প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করে। ইরাক যুক্তি হিসাবে দেখায়, “Kuwait was a natural part of Iraq carved off as a result of British imperialism”।
একই দিন সর্ব পশ্চিমের সুদূরবর্তী সমুদ্র উপকূলবর্তী ভূখণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থানরত তৎকালীন কুয়েতি রাষ্ট্রদূত শেখ সাউদ নাসির আল সাবাহ মিডিয়াকে জানায়ঃ “We have appealed to all our friends around the world, including the USA, to come to our aid and assistance; we would like to have military assistance in order to survive.”
নানা ঘটনার পরিক্রমা পেরিয়ে ১৯৯১ সালের ১৭ই জানুয়ারি বোমারু বিমানের মাধ্যমে বাগদাদ নগরীর উপর বোমা বর্ষণের মাধ্যমে শুরু হয় ইরাককে কুয়েত ছাড়ার জন্য বল প্রয়োগ। ৩৪ টি দেশের পদাতিক বাহিনীর অংশগ্রহণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী গঠন করা হয়। দেশসমূহঃ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, মিশর, ফ্রান্স, গ্রীস, ইতালি, কুয়েত, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নাইজার, নরওয়ে, ওমান, পাকিস্তান, পর্তুগাল, কাতার, দক্ষিন কোরিয়া, সৌদি আরব, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সিঙ্গাপুর, সিরিয়া, স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজে। ১৫ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে পদাতিক আক্রমণ।
২৮ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে জোটের নেতৃত্বদানকারী সর্ব পশ্চিমের সুদূরবর্তী সমুদ্র উপকূলবর্তী ভূখণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক নেতা জর্জ বুশ কুয়েতকে মুক্ত ঘোষণা করে এবং ‘আল সাবাহ’ রাজ পরিবারকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেয়। আর ইরাকের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
ইমাম মাহাদির আত্মপ্রকাশের পরে এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের রাজ বংশের আমিরের কার্যকলাপ, তার শেষ পরিণতি এবং এই ভূখণ্ডের রঙ্গিন জাতীয়তাবাদের পতাকা ছেড়ে ইমাম মাহদির ‘খেলাফতের কালো কালিমা খচিত সাদা পতাকা’ কিংবা ‘সাদা কালিমা খচিত কালো সামরিক পতাকা’ অধীনে আসার ঘটনা এখন সময়ের ব্যাপার।
আসুন, এবার আমরা ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে এই ইরাক নামক ভূখণ্ডের উপর অবরোধ আরোপ সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নেই।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“ইরাক তার ‘দিরহাম’ ও ‘কাফিজ’ (তেল মাপার আঞ্চলিক একক) এর প্রচলন থামিয়ে দিবে, সিরিয়া তার ‘মাদ’ (গম/চাল মাপার সিরীয় একক) ও ‘দিনার’ এর প্রচলন থামিয়ে দিবে আর মিশর তার ‘ইরদাব’ (গম/চাল মাপার মিসরীয় একক) ও ‘দিনার’ এর প্রচলন থামিয়ে দিবে। তোমরা আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে যেখান থেকে শুরু করেছিল, তোমরা আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে যেখান থেকে শুরু করেছিল, তোমরা আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবে যেখান থেকে শুরু করেছিল। আবু হুরায়রার রক্ত মাংস এর সাক্ষ্য বহন করে”। (সহিহ মুসলিম, অধ্যায় ৪১, হাদিস নং ৬৯২৩)
আবু নাদ’রা বর্ণনা করেন, আমরা হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি বললেন,
“সেই সময়টি অতি নিকটে, যখন ইরাকিদের ‘দিরহাম’ ও ‘কাফিজ’ এর উপর অবরোধ আরোপ করা হবে”। জিজ্ঞেস করা হল, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে আরোপ করা হবে? উত্তরে তিনি বললেন, “অনারবদের পক্ষ থেকে”। এরপর বললেন, “সেই সময়টিও বেশি দূরে নয়, যখন সিরিয়ার অধিবাসীদের ‘মাদ’ ও ‘দিনার’ এর উপরও অবরোধ আরোপ করা হবে”। জিজ্ঞেস করা হল, এই অবরোধ কার পক্ষ থেকে হবে? বললেন, “পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে”। কিছু সময় নীরব থাকার পর বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার শেষ উম্মতের মধ্যে এমন এক খলীফার (ইমাম মাহদির) আবির্ভাব ঘটবে, যে মানুষকে মুঠি ভরে ভরে সম্পদ দান করবে এবং কোন হিসাব গণনা করবে না”। (সহিহ মুসলিম, অধ্যায় ৪১, হাদিস নং ৬৯৬১)
হাদিসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এমনকি অবরোধ আরোপের সিরিয়াল পর্যন্ত দেওয়া আছে। এই লিখাটি শুধু ইরাক সম্পর্কিত হওয়ায় আমরা শুধু ৬ ই আগস্ট ১৯৯০ থেকে শুরু হওয়া ইরাকি অবরোধ নিয়ে আলোচনা করব (যদিও ২০১১ এর আগস্ট থেকে সিরিয়ার উপরও অবরোধ চলছে এবং এখনও মিশরের উপর কোন অবরোধ আরোপ হয়নি, ২০১৩ মিডিয়াতে সামান্য সম্ভাবনার আলাপ আলোচনা হয় মাত্র)।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে শুধু “পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে” বলা হলেও ইরাকের ক্ষেত্রে “অনারবদের পক্ষ থেকে” বলা হয়েছে এবং কুয়েত দখলের পরপরই ৬ ই আগস্ট ১৯৯০ তারিখে হাদিসের শাব্দিক প্রয়োগকে বাস্তবে রুপ দিয়ে প্রথম অনারব সংগঠন (পশ্চিম, পূর্বসহ সকল জাতীয়তার সংগঠন) “আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিষদ” কর্তৃক ইরাকের উপর অর্থনৈতিক ও সব ধরনের বানিজ্যের উপর বানিজ্যিক অবরোধ আরোপ করা হয়। হাদিসে বলা হয়েছে, “ইরাকিদের ‘দিরহাম’ ও ‘কাফিজ’ এর উপর অবরোধ আরোপ করা হবে”।
দিরহাম = অর্থ
কাফিজ = তেল মাপার আঞ্চলিক একক
১ দিনার = ৭২ টি বার্লি দানার সম ওজন সম্পন্ন স্বর্ণ মুদ্রা। বর্তমান ৪.৪৫গ্রাম সোনা।
১ দিরহাম = ০.৭ দিনার (৭০% স্বর্ণ দিনার)
২০০৩ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই ইরাকি সেন্ট্রাল ব্যাংক ইরাকি দিনার নোট থেকে ‘০০০’ তুলে দিয়ে সমমানের নতুন একক প্রচলনের চেষ্টা করছে। যার প্রথম চালান ২০১৪ তে আসার কথা।
উল্লেখ্য যে, ইতিহাসে ‘কাফিজ’ শব্দটি সব সময়ই তৈল মাপার একক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিন ইতালির উপর আরব প্রভাব থাকার কারণে তৈল মাপার এককের ক্ষেত্রে সিসিলিয়ান ভাষায় আরবি ভাষার “কাফিজ” শব্দের অনুরূপ “কাফিসু” (Kafisu /kafiso) শব্দ এসেছে।
এক টানা ১৩ বছর পর্যন্ত এই অবরোধের পর ২০০৩ সালের ২২ শে মে অধিকাংশ অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। অবরোধের যেই শর্তগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তৈল কোম্পানির অনুকূলে ছিল সেগুলো ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবত ছিল। আর অবরোধের যেই শর্তটি কুয়েত দখলের ক্ষতিপূরণ হিসাবে এখনও ইরাকের গ্যাস ও তৈল বিক্রির উপার্জন উপর থেকে ৫% কেটে নেয়, সেটি এখনও বলবত আছে।
কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং অধ্যাপক রিচার্ড গারফিল্ড তার সেপ্টেম্বর ৪, ২০০৩ এ প্রকাশিত “The Iraqi babies scam is still alive” নিবন্ধে যুদ্ধ ব্যতীত শুধু এই অবরোধের ফলে অতিরিক্ত ৩,৪৫,০০০ থেকে ৫,৩০,০০০ নারী, শিশু ও বেসামরিক ইরাকির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন।
আসুন, এবার আমরা ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে যুদ্ধে এই অঞ্চলের সংশ্লিষ্টতা সম্বলিত হাদিসগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
“সেই সময়টি অতি নিকটে, যখন পশ্চিমা জনগোষ্ঠী তোমাদেরকে ইরাকের মাটি থেকে বের করে দেবে”।
বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম, পরে কি আমরা ফিরে আসব? উত্তরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তা কামনা করছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, “পরে তোমরা ফিরে আসবে। আর তখন তোমরা (ইরাকে) সচ্ছল ও সাচ্ছন্দ্যময় জীবন লাভ করবে”। (আল ফিতান,খণ্ড ৪; পৃষ্ঠা ৯০৭)
“শেষ জামানায় বাগদাদ আগুনে ধ্বংস হবে”। (রিসালাতুল হুরুজ উল মাহদি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৭৭)
হযরত আবু উছমান আন নাহদি বর্ণনা করেন, আমি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) এর সাথে কাতারবালে অবস্থান ক্রছিলাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই লোকালয়টির নাম কি?
আমি বললাম, কাতারবাল।
তারপর তিনি দুজাইলের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন, ওটির নাম কি?
আমি বললাম, দুজায়লা।
তারপর তিনি সুরাতের (বর্তমান সুরাহ’ দি) দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন, ওটির নাম কি? আমি বললাম, এই অঞ্চলের নাম সুরাত। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“দজলা, দুজাইল, কাতারবাল ও সুরাতের মধ্যখানে একটি নগরী তৈরি হবে, যেখানে জগতের ধন-দৌলত ও অত্যাচারী লোকদের সমবেত করা হবে। নগরীর অধিবাসীরা ধ্বসে যাবে। এই নগরীটি লোহার পেরেকেরও চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে মাটির মধ্যে ধ্বসে যাবে”। (তারীখে বাগদাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩০)
দুজাইল বাগদাদ ও তিরকিতের মধ্যখানে সামারা নগরীর সন্নিকটে অবস্থিত।
আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে আনাস, লোকেরা অনেক শহর তৈরি করবে এবং তাদের একটি হবে বসরা। তুমি যদি এর পাশ দিয়ে যাও কিংবা এতে প্রবেশ কর, তবে এর নদীর সাথে উপকূলবর্তী লোনা ভেজা এলাকা, এর আশে পাশের এলাকা, এর বাজার, এর প্রভাবশালীদের দরজা এড়িয়ে চোলো, আর গ্রাম্য এলাকা দিয়ে চলাচল করো। কারণ, এর কোথাও ভূমিধ্বস হবে, কোথাও প্রবল বর্ষণ হবে আবার কোথাও ভূমিকম্প হবে। এবং সেখানে কিছু লোক এমন হবে যে তারা সেখানে রাত কাটাবে আর পরদিন সকালে বানর ও শূকরে পরিণত হবে”। (সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায় ৩৭, হাদিস নং ৪২৯৩)
অপর বর্ণনায় আছে,
“দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে জাওরা (বাগদাদ) শহর প্রতিষ্ঠিত হবে। সেখানে প্রবল যুদ্ধ হবে। মেয়েদেরকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে নেওয়া হবে আর পুরুষদেরকে ভেড়ার মতো জবাই করে হত্যা করা হবে”। (মুন্তাখাব কানাজুল উম্মাল, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৮)
২০০১ এ খোরাসান আক্রমণের পর থেকে সর্ব পশ্চিমের সুদূরবর্তী সমুদ্র উপকূলবর্তী ভূখণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক নেতা জর্জ বুশ ইরাক আক্রমণের জন্য নানারূপ অজুহাত খুঁজতে থাকে। দুই বছর যাবত পশ্চিমা দাজ্জালি মিডিয়া ও বিশ্বের বিভিন্ন ভূখণ্ডের দালাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা ইরাককে বিশ্বে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরিকারী এবং সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসাবে প্রচার করে মিডিয়া যুদ্ধ করতে থাকে।
অবশেষে একক সিদ্ধান্তে তথাকথিত গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান জাতি সংঘের তোয়াক্কা না করে ২০০৩ সালের ২০ শে মার্চ রাত ২:৩০ এ বাগদাদে বোমারু বিমান হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড নামক বর্তমান কালের দুই পশ্চিমা কর্ণধার ইরাক আক্রমণ করে। এরপরের দিনই যুক্তরাষ্ট্র (১,৪৮,০০০ সৈন্য), ইংল্যান্ড (৪৫,০০০ সৈন্য), অস্ট্রেলিয়া (২,০০০ সৈন্য) ও পোল্যান্ড (১৯৪ জন সৈন্য) কুয়েত সীমানার নিকটবর্তী পদেশ বসরাতে পদাতিক অভিযান শুরু করে।
পরবর্তীতে তাদের এই জোটের রঙ্গিন পতাকাবাহী ভূখণ্ডের সংখ্যা চল্লিশে গিয়ে পৌঁছেঃ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রুমানিয়া, এলসালভাদর, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া, মালডোভা, আলবেনিয়া, ইউক্রেইন, ডেনমার্ক, চেক রিপাবলিক, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান, টোঙ্গা, আজারবাইজান, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, লাটভিয়া, পোল্যান্ড, কাজাখস্তান,আরমেনিয়া,মংগোলিয়া, জর্জিয়া, স্লোভাকিয়া, লিথুনিয়া, ইটালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরী, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্স, হন্ডোরাস, ডমিনিকান রিপাবলিক, স্পেন, নিকারাগুয়া, আইসল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘বহুজাতিক বাহিনী – ইরাক’ Multi National Force – Iraq (MNF-I) এবং তার অফিসিয়াল মনোগ্রামে হলুদ রঙ্গের আধিক্য। এবং ধীরে ধীরে অল্প সময়ের মধ্যে গোটা ভূখণ্ড দখলে নিয়ে নেয়।
আর এই যুদ্ধের সঠিক যুদ্ধ বন্দী পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। আর তাদের উপর পরিচালিত অকথ্য নির্যাতন ও ধর্ষণের কাহিনী আবু গাইরিব কারাগার হতে বের হউয়া ছবি, অতি উৎসাহে ধারণকৃত ভিডিওর মাধ্যমে অনেক সচেতন মুমিনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
অপর বর্ণনায় এসেছে,
“ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ইরাক আক্রান্ত হবে এবং নিরপরাধ ইরাকবাসী সিরিয়াতে আশ্রয় নিবে। সিরিয়া পুনঃনির্মিত হবে এবং ইরাক পুনঃনির্মিত হবে”। (মুন্তাখাব কানাজুল উম্মাল, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৫৪)
২১ শে জুন ২০০৭ পর্যন্ত UNHCR এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ঐ পর্যন্ত ২২ লক্ষ ইরাকি পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরমধ্যে ১০ লক্ষ ইরাকি সিরিয়াতে এবং সাড়ে ৭ লক্ষ ইরাকি জর্ডানে (তৎকালীন বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ) আশ্রয় গ্রহণ করে।
আল্লাহ যখন জমিনে কোন কিছু ঘটাতে চান, তখন উনি তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক যে শাসন ব্যবস্থা ইরাকের ভূখণ্ডে সম্ভব হয়নি জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সাদ্দাম হোসেনের আমলে, তা পুনঃনির্মিত হল পশ্চিমাদের আগ্রাসনের পরে। ১৫ ই অক্টোবর ২০০৬ তে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর ইসালামপন্থীরা Islamic State of Iraq (ISI) গঠনের ঘোষণা দিল। তারা নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় আল আনবার প্রদেশ, নিনাওয়া প্রদেশ, কিরকুক প্রদেশ, সালাদিন প্রদেশের অধিকাংশ এবং বাবিল, দিয়ালা, বাগদাদ প্রদেশের একাংশে। আর বাকুবাকে রাজধানী ঘোষণা করে এবং মার্কিন জোটের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে থাকে। রাসুল (সাঃ) এর বংশীয় একজনকে তারা আমীর নিযুক্ত করেছে। এমনকি ২০১১ সালে জোট বাহিনীর প্রস্থানের পরও তারা আজ পর্যন্ত ইরাকের পুতুল সরকারের মোকাবিলা করছে। এই ভূখণ্ডটি পতাকা কালোর ভিতরে সাদা কালিমা খচিত, এরা জাতীয়তাবাদী কোন রঙ্গিন পতাকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিরিয়াতে বনু কাল্ব গোত্রের অত্যাচারী শাসক বাশার আল আসাদ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা’আর সাথে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এরপরে ২০১২ সালে এই Islamic State of Iraq (ISI) সেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ পূর্বক সীমানা বাড়িয়ে সিরিয়ার আল রাক্কা, ইদলিব এবং আলেপ্পো প্রদেশে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে এবং নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের নতুন নাম দেয় Islamic State of Iraq and Sham (ISIS). তাদের নিজস্ব কোর্ট ভবন, পুলিশ প্রশাসন, সামরিক শাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুনর্বাসন বিভাগসহ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে। ইউটিউবে The Light Revelations Pt. 5 (Syria_ Stories Of Allegiance) H লিখে সার্চ দিলে এর উপর একটি ভিডিও দেখা যাবে।
আর এই খবরটিকে পশ্চিমা দাজ্জালি মিডিয়া ও বিশ্বের বিভিন্ন ভূখণ্ডের দালাল মিডিয়া বরাবরই ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে রেখেছে এবং রাখছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল বসরা (ইরাকের শহর) নামক স্থানে এসে উপনীত হবে। ওখানে তাদের সংখ্যা এবং বিদ্রোহ প্রচুর পরিমাণে হতে থাকবে। এরপর পশ্চিমারা আসবে। ঐ সময় মুসলমান তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, একদল উটের লেজ ধরে মরুভূমিতে চলে যাবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় দল নিজেদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে বসে যাবে এবং কাফের হয়ে যাবে। এই দল এবং প্রথম দল শাস্তির যোগ্য হবে। আর তৃতীয় দল পরিবারকে পেছনে ফেলে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসবে। সুতরাং তাদের নিহতরাই জান্নাতে যাবে এবং এদের অবশিষ্টদের হাতেই আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করবেন”। (মুসনাদে আহমাদ , হাদিস নং ২০৪৭৫)
উল্লেখ্য বিমান হামলার পরের দিন সর্বপ্রথম পদাতিক আক্রমণ এই বসরা দিয়েই শুরু হয়েছিল। পশ্চিমাবাসীদের পক্ষ হয়ে প্রথম থেকেই ইরাকিদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় কুর্দিদের একটি গ্রুপ।
ইরাকের তখন সরকারীভাবে ৩,৭৫,০০০ পদাতিক সেনা, ২০০০ নৌ সেনা, ২০০০০ বিমান সেনা, ১৭০০০ আকাশ প্রতিরক্ষা সেনা, ৪৪০০০ আধাসামরিক, ৮০০০০ রিপাবলিকান গার্ড এবং রিসার্ভ ৬,৫০,০০০ সেনা ছিল। এদের একটা অংশ যুদ্ধে অংশ নেয়, অনেকে বন্দী হয় আবার অনেকে নিহত হয়। কিন্তু এই সরকারী বাহিনীর বাইরে ছিল স্থানীয়ভাবে অনেক ছোট ছোট দল।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“এমন সব বিপদ আপদ আসবে যে মানুষ কোন আশ্রয় খুঁজে পাবে না। এই বিপদ আপদগুলো বৃহত্তর সিরিয়ায় (জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, দখলদার ইসরাইল) ঘুরে বেড়াবে, ইরাকে গিয়ে পড়বে আর জাজিরাতুল আরবের হাত পা বেধে ফেলবে। একদল লোক এই বিপদ আপদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কেউই এদের (লড়াইকারীদের) ব্যাপারে সহমর্মিতা প্রকাশ করবে না অথবা বলবে না, ‘হায়!!’। যখন তারা এক পাশ থেকে এই বিপদ আপদকে সরিয়ে দিবে, তখন অন্য পাশ থেকে বিপদ আপদ শুরু হবে”। (মুন্তাখাব কানাজুল উম্মাল, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯)
এছাড়া শুধু ইমানী দায়িত্ব হিসাবে মুসলিম ভাই ও বোনের সাহায্যের জন্য জীবন হাতে নিয়ে ইরাকি ভূখণ্ডের বাইরে থেকে এসে হাজির হন অনেক মুসলমান। এদের মধ্যে পশ্চিমা জোটের হাতে ২০০৫ পর্যন্ত মিশর, সিরিয়া, সুদান, সৌদি আরব, জর্ডান, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, প্যালেস্টাইন, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তুরস্ক, লেবানন, ভারত, কাতার, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল, কুয়েত, মেকাডোনিয়া, মরক্কো, সোমালিয়া, ইয়েমেন এর মোট ৬১৯ জন পাসপোর্টধারী বন্দী হন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“ইরাকবাসীরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। একভাগ যুদ্ধকালীন সময়ে লুঠতরাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। এক দল পরিবার পরিজনকে ফেলে পালিয়ে যাবে। আর একদল যুদ্ধ করবে। যখন তুমি এহেন অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে, তখন তুমি কেয়ামতের জন্য প্রস্তুতি নাও”।
(ফারাইদ ফাওয়াইদ ফিকির ফি ইমাম আল মাহদি আল মুন্তাজার)
এই হাদিসে যুদ্ধকালীন ইরাকবাসিদের আচরণ যেভাবে বলা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি অর্থমূল্যের লুটতরাজ হয়েছিল বাগদাদ জাতীয় যাদুঘরে। এছাড়া গোটা যুদ্ধের শুরুর থেকে সারা ভূখণ্ডে প্রায় ৫০১০০ টি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী লুটের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। ২০০৫ সালে কর্নেল ম্যাথিউ বোগদানোস তার Thieves of Bagdad বইতে এর অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে। আর এই যুদ্ধকে শেষ জামানের একটি আলামত হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
আরেক বর্ণনায় এসেছে,
“ইরাকিদের কোন ওজনমাপক যন্ত্র পর্যন্ত থাকবে না এবং কেনা বেচার জন্য কোন অর্থ পর্যন্ত থাকবে না”। (মুন্তাখাব কানাজুল উম্মাল, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৪৫)
এর দ্বারা মূলত যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। এর একটা চিত্র ইরাক ইরান যুদ্ধের পরেই ফুটে উঠে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ আর যুদ্ধের পরে তা তীব্র রূপ ধারণ করে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“অদূর ভবিষ্যতে ফোরাত সোনার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেবে। সে সময়ে এ ওখানে উপস্থিত থাকবে, সে যেন তার থেকে কিছুই গ্রহণ না করে”। (সহিহ বুখারি, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৬০৫; সুনানে তিরমিজি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬৯৮)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“সেই পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফোরাত থেকে সোনার পাহাড় বের হবে। তার জন্য মানুষ যুদ্ধ করবে এবং প্রতি একশ জনে নিরানব্বই জন লোক মারা যাবে। যে কজন জীবনে রক্ষা পাবে, তারা প্রত্যেকে মনে করবে, বোধ হয় একা আমিই জীবিত আছি”। (সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২১৯)
দজলা ও ফোরাত নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এবং এ নিয়ে নাসার গবেষকরাও খুবই চিন্তিত ।
১২/০২/২০১৩ এ একটা রিপোর্টে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, নাসার গবেষকরা এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি লক্ষ করছে, গত ১০ বছরে ১১৭ লক্ষ একর ফুট খাদের পানি শুকিয়ে গেছে।
অর্থাৎ এই নদীর পানি শুকানো হচ্ছে কেয়ামতের কয়েকটা আলামতের একটা। কিন্তু কেয়ামত আসার আগে অনেক কিছুই ঘটবে, যেমন ইমাম মাহদি এবং দজ্জালের আবির্ভাব ।
আবার কেউ কেউ এই হাদিসের ব্যাখ্যা করেছেন, এখানে ‘স্বর্ণ’ বলতে তেলসম্পদকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, খনিজ তেলকে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ বলা হয়। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধে ফোরাত নদীর উপকূলবর্তী শহর ফালুজাতে মার্কিন ও মুজাহিদদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়েছিল।
ইমাম মাহদির আগমনের ঠিক পূর্ব হতে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে উনার অবস্থানকালীন ও নেতৃত্বাধীন সকল যুদ্ধের ধারাবাহিক বর্ণনা সহকারে ইয়াজুজ মাজুজ হয়ে কিয়ামতের সমস্ত আলামত বর্ণনা করে হযরত হুজায়ফা (রাঃ) এর সুবিস্তৃত হাদিস আছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু এখন ইরাক, তাই শুধু এর সাথে সংশ্লিষ্ট ধারাবাহিক অংশটি বর্ণনা করছি।
হযরত হুজায়ফা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বলেন, “জাওরায় (বর্তমান বাগদাদ) যুদ্ধ হবে”। সাহাবাগন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, জাওরা কি? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “পূর্বদিককার একটি শহর, যেটি কয়েকটি নদীর মধ্যখানে অবস্থিত। আল্লাহর সৃষ্টিকূলের নিকৃষ্টতম সৃষ্টি ও আমার উম্মতের অত্যাচারী লোকেরা সেখানে বাস করে। তাদের উপর চার ধরনের শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হবে। অস্ত্রের শাস্তি (মানে যুদ্ধ), মাটিতে ধ্বসে যাওয়ার শাস্তি, পাথরের শাস্তি ও আকৃতি বিকৃত হওয়ার শাস্তি”।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বললেন, “যখন সুদানিরা বের হবে এবং আরবদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাবে, এমনকি আরবরা বাইতুল মুকাদ্দাস কিংবা উর্দুন (বর্তমান জর্ডান) পৌঁছে যাবে, ঠিক এমন সময় সুফিয়ানি (সিরিয়ার বনু কাল্ব গোত্রীয় কুরায়শি শাসক) তিনশো ষাট অশ্বারোহী সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসবে। তবে কোন একটি মাস অতিবাহিত হবে না, যাতে বনু কাল্বের ত্রিশ হাজার মানুষ তার হাতে বাইয়াত করবে”।
সুফিয়ানি একটি বাহিনী ইরাকে প্রেরণ করবে, যার ফলে জাওরায় এক লাখ মানুষ নিহত হবে। তার অব্যাহতির পর সে দ্রুত গতিতে কুফার দিকে অগ্রসর হবে এবং কুফাকে লুণ্ঠন করবে। এমন সময় পূর্বদিক (খোরাসান) থেকে ‘দাব্বা’ আত্মপ্রকাশ করবে, যাকে বনু তামিমের সুয়াইব বিন সালিহ নামক এক ব্যক্তি হাকিয়ে নিয়ে আসবে। এই লোকটি সুফিয়ানির সৈন্যদের হাত থেকে কুফার বন্দিদের ছাড়িয়ে আনবে এবং সুফিয়ানির সৈন্যদেরকে হত্যা করবে”। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতুল ফিল ফিতান, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১০)
এই হাদিসে ‘জাওরা’য় যুদ্ধ হবে বলা হয়েছে। ‘জাওরা’ বাগদাদের অপর নাম। এই অঞ্চলটি ‘দজলা’ ও ‘ফোরাত’ দুটি নদীর মধ্যখানে অবস্থিত।
হাদিসে খোরাসান থেকে একটি ‘দাব্বা’ আত্মপ্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ বাহন। যেটি চালাবেন বনু তামিম গোত্রের সুয়াইব বিন সালিহ নামক এক ব্যক্তি। হতে পারে, এটি খোরাসান থেকে আগত বাহিনীর একটি অংশ।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, এখানে হাদিসে রাসুল (সাঃ) ইরাকের যুদ্ধের পরই সিরিয়াতে বনুকাল্ব গোত্রের এক অত্যাচারী কুরায়শি শাসকের আবির্ভাবের ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
আর ২০১১ সালে ডিসেম্বরে জোট বাহিনীর শেষ সেনাদলের প্রস্থানের পর ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। আর ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সিরিয়ার শিয়া আকিদায় বিশ্বাসী বনুকাল্ব গোত্রের কুরায়শি শাসক বাশার আল আসাদের অত্যাচারী রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করে। সিরিয়াতে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর সাথে তার অনুসারী সমগোত্রীয় নুসাইরিয়া সম্প্রদায় সব ধরনের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধযান নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করব “সিরিয়ার বনুকাল্ব গোত্রের কুরায়শি শাসকঃ ইমাম মাহদির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে হাদিস ও সেখানে দাজ্জালি এডভান্স ফোর্সের বর্তমান কার্যক্রম” লিখাতে।
আব্দুল্লাহ ইবনে হাওয়ালাহ (রাঃ) আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, যে উনি বলেছেনঃ
“পরিস্থিতি তার কাজের ধারা অনুযায়ী চলতে থাকবে যতক্ষণ না তোমরা তিনটি বাহিনীতে পরিণত হওঃ একটি বাহিনী সিরিয়ার, একটি বাহিনী ইয়েমেনের আর আরেকটি ইরাকের”।
ইবন হাওয়ালাহ (রাঃ) বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে আমার জন্য একটি বাহিনী নির্ধারন করে দিন’।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন,
“তোমার সিরিয়া যাওয়া উচিত হবে কারন এটি আল্লাহর ভূমিদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, এবং উনার শ্রেষ্ঠ বান্দারাই সেখানে জড়ো হবে! এবং যদি তুমি তা না চাও তবে তোমার ইয়েমেনে যাওয়া উচিত এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করা উচিত। কারন আল্লাহ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, উনি সিরিয়া এবং তার মানুষের উপর খেয়াল রাখবেন”!
(ইমাম আহমেদ ৪/১১০, আবু দাউদ ২৪৮৩)
এই হাদিসের প্রথম লাইনের বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। আজ এই মুহূর্তে এই তিন দেশে এরকম তিনটি বাহিনী অবস্থান নিয়েছে।
আগামী “সিরিয়ার বনুকাল্ব গোত্রের কুরায়শি শাসকঃ ইমাম মাহদির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে হাদিস ও সেখানে দাজ্জালি এডভান্স ফোর্সের বর্তমান কার্যক্রম” ও “ইয়েমেনঃ ইমাম মাহদির আগমনের পূর্বে ও পরে যুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে হাদিস ও সেখানে দাজ্জালি এডভান্স ফোর্সের বর্তমান কার্যক্রম” এ বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাল্লাহ।
হাদিসে বর্ণিত সেই অত্যাচারী সিরিয়ার বনুকাল্ব গোত্রের কুরায়শি শাসক একদিন ইরাকের কুফা নগরী পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
আরেক বর্ণনায় আছে,
“কুফার অধিবাসীরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। এক ভাগ বনুকাল্ব গোত্রের সিরীয় শাসকের সাথে যোগ দিবে। এরা আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত হবে। একভাগ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং তারা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর তৃতীয় ভাগ এই যুদ্ধকালীন সময়ে লুঠতরাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং তারা পাপী হিসাবে বিবেচিত হবে”। (আন নাজমুস সাকিব ফি বাইয়ানি আন্নাল মাহদি মিন আবদাল আলী বিন আবু তালিব)
কুফা শহরটি ইরাকের বাগদাদ নগরীর ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিনে এবং নাজাফের ১০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত। এটির অবস্থান ফোরাত নদীর তীরে। নাজাফ, সামারা, কারবালা, কাদিমিয়া এবং নাজাফের মতোই কুফা শিয়া আকিদায় বিশ্বাসী প্রধান একটি নগরী।
রয়টার্সের অন লাইন সংস্করণ www.reuters.com এ গত ১৬ ই অক্টোবর ২০১২ তারিখের প্রতিবেদন Iraqi Shi'ite militants fight for Syria's Assad এ ইরাকের এই সব শিয়া আকিদায় বিশ্বাসী প্রধান নগরীগুলো থেকে সিরিয়ায় গিয়ে বনু কালব গোত্রের বর্তমান অত্যাচারী শাসক বাসার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের খবর নিশ্চিত করেছে।
মিনাতে হজ্জের মৌসুমে রক্তাক্ত সংঘাতের পর ইমাম মাহদির আত্ম প্রকাশের পর খোরাসানের কালো পতাকাবাহীদের পরে ইরাকের ‘আসাইব’-রাই হবেন সেই ভাগ্যবান, যারা ইমাম মাহদির হাতে বাইয়াত হবেন।
উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“জনৈক খলীফার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে করে বিরোধ সৃষ্টি হবে। তখন মদিনার একজন লোক পালিয়ে মক্কা চলে আসবে (এই আশঙ্কায় যে, পাছে মানুষ আমাকে খলীফার পদে অধিষ্ঠিত করে কিনা)। মক্কার লোকেরা তাঁকে খুঁজে বের করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুকুন এবং মাকামে ইব্রাহিমের মাঝামাঝি স্থানে বাইয়াত গ্রহণ করবে।
বাইয়াতের খবর শুনে সিরিয়ার দিক থেকে এক বিশাল বাহিনী প্রেরিত হবে। মক্কা মদিনার মাঝামাঝি বায়দা নামক স্থানে এসে পৌঁছানোর পর এই বাহিনীটিকে ভূগর্ভে ধসিয়ে দেওয়া হবে। বাহিনী ধ্বসের সংবাদ শুনে সিরিয়ার ‘আবদাল’ (শ্রেষ্ঠ মুসলমানগণ) ও ইরাকের ‘আসাইব’ (সম্মানিত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ) মক্কায় এসে তাঁর (ইমাম মাহদির) নিকট বাইয়াত হবে। অতঃপর সিরিয়ার বনু কালব গোত্রের এক কুরায়শী শাসকের আবির্ভাব হবে। সিরিয়ার দিক থেকে সে বাহিনী প্রেরণ করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে পরাস্ত করবেন, যার ফলে তাদের উপর বিপদ নেমে আসবে। এটিই হল ‘কালবের যুদ্ধ’। যে ব্যক্তি কালবের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে, সে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হবে। তাঁরপর তিনি ধনভাণ্ডার খুলে দেবেন, মাল দৌলত বণ্টন করবেন এবং ইসলামকে বিশ্বময় খেলাফতের আদলে সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে সাত বছর কিংবা (বলেছেন) নয় বছর”। (আল মু’জামুল আওসাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৫; মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস ৬৯৪০; ইবনে হিব্বান, হাদিস ৬৭৫৭; আল মু’জামুল কাবীর, হাদিস ৯৩১)
উপরে উল্লেখিত সিরিয়ার বনু কালব গোত্রের এই কুরায়শী শাসক ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের আগ দিয়ে ইরাকের কুফা শহরেও তার বাহিনী প্রেরণ করবে।
উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“বনু কালব গোত্রের এক কুরায়শী শাসক সিরিয়াতে আত্মপ্রকাশ করবে। তার পর সে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা করবে। সে সময় মদিনা আক্রমণের জন্য সে একটি বাহিনী প্রেরণ করবে। তারা আল্লাহপাকের ইচ্ছানুপাতে যুদ্ধ করবে। এমনকি গর্ভস্থিত সন্তানটিকে পর্যন্ত সে হত্যা করবে। এই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফাতেমার কিংবা বলেছেন আলীর বংশের এক আশ্রয় গ্রহণকারী হারামে আশ্রয় গ্রহণ করবে। তখন তাকে ধরার জন্য উক্ত বাহিনী তার কাছে ছুটে যাবে। বাহিনীটি বায়দা নামক স্থানে উপনীত হওয়ার পর তাদের ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। শুধু সেই লোকটি রক্ষা পাবে, যে মানুষকে সতর্ক করে বেড়াবে”। (ইলাল, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪২৫)
খোরাসান থেকে বের হওয়া কালো পতাকাবাহী বাহিনী ইমাম মেহেদীর হাতে বাইয়াত গ্রহণের পূর্বে ইরাকের কুফা নগরীতে সিরিয়ার বনু কাল্ব গোত্রীয় কুরায়শি শাসকের (হাদিসের বর্ণনাগুলোতে ‘সুফিয়ানি’ হিসাবে এসেছে) মোকাবিলা করবে।
হযরত আরতাত (রাঃ) বলেন,
“সুফিয়ানি কুফায় প্রবেশ করবে। তিনদিন পর্যন্ত সে দুশমনদের বন্দীদেরকে সেখানে আটকে রাখবে এবং সত্তর হাজার কুফাবাসীকে হত্যা করে ফেলবে। তারপর সে আঠার দিন পর্যন্ত আঠার দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে তাদের (কুফাবাসীদের) সম্পদগুলো বণ্টন করবে। তাদের (কুফাবাসীদের) মধ্যে একদল খোরাসানে ফেরত যাবে। সুফিয়ানির সৈন্যবাহিনী আসবে এবং কুফার বিল্ডিংগুলো ধ্বংস করে সে খোরাসানবাসীদেরকে তালাশ করবে। খোরাসানে একটি দলের আবির্ভাব ঘটবে, যারা ইমাম মাহদির দিকে আহ্বান করবে। অতঃপর মাহদি ও মানসুর (একজন সেনাপতি) উভয়ে উভয়ে কুফা থেকে পলায়ন করবে। সুফিয়ানি উভয়ের তালাশে সৈন্য প্রেরণ করবে। অতঃপর যখন মাহদি ও মানসুর মক্কায় পৌঁছে যাবে, তখন সুফিয়ানির বাহিনীকে ‘বায়দা’ নামক স্থানে মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। এরপর মাহদি মক্কা থেকে বের হয়ে মদিনায় যাবেন এবং ওখানে বনু হাশেমকে মুক্ত করবেন। এমন সময় কালো পতাকাবাহী লোকেরা এসে পানির উপর অবস্থান করবে। কুফায় অবস্থিত সুফিয়ানির লোকেরা কালো পতাকাবাহী দলের আগমনের কথা শুনে পলায়ন করবে। কুফার সম্মানিত লোকেরা বের হবে যাদেরকে ‘আসহাব’ বলা হয়ে থাকে, তাদের কাছে কিছু অস্ত্র শস্ত্রও থাকবে এবং তাদের মধ্যে বসরা’বাসীদের থেকে একজন লোক থাকবে। অতঃপর কুফাবাসী সুফিয়ানির লোকদেরকে ধরে ফেলবে এবং কুফার যে সব লোক তাদের হাতে থাকবে, তাদেরকে মুক্ত করবে। পরিশেষে কালো পতাকাবাহী দল এসে মাহদির হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে”।
(আল ফিতানঃ ৮৫০, মুহাক্কিক আহমদ ইবনে সুয়াইব এই হাদিসটির সনদকে ‘লাবাসা বিহা’ বা ‘বর্ণনাটি গ্রহণ করা যেতে পারে’ বলেছেন)
ইতিমধ্যে Islamic State of Iraq and sham এর কালো পতাকা বহন করে বৃহত্তর খোরাসানের অন্যতম অংশ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজিকিস্তান থেকে আগত মুসলিমরা সিরিয়াতে বর্তমান বনু কাল্ব গোত্রীয় শাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। ভবিষ্যতে কি হবে আল্লাহই ভালো জানে।
এখন আমরা ইমাম মাহদির নেতৃত্বে সংঘটিত মহাযুদ্ধের পূর্বে ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসের ব্যাপারে কিছু হাদিসকে খুব সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করব। শহর-নগরীর ধ্বংস বা ক্ষয়ক্ষতি যে সব হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোতে ‘খারাবুন’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দটি পুরোপুরি হোক বা আংশিক সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা ধবংসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
হযরত মাছজুর ইবনে গায়লান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,
“সবার আগে ধ্বংস হওয়া ভূখণ্ড হল বসরা (বর্তমান ইরাকে) ও মিশর”। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি কারণে তাদের ধ্বংস নেমে আসবে; ওখানে তো অনেক বড় সম্মানিত ও বিত্তবান ব্যক্তিরা আছেন?’ উত্তরে আবদুল্লাহ ইবনে সামিত (রাঃ) বললেন, “রক্তপাত, গণহত্যা ও অত্যাধিক ক্ষুধা। আর মিসরের সমস্যা হল নীলনদ শুকিয়ে যাবে আর এটিই মিসরের ধবংসের কারণ হবে”। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯০৭)
যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক দখলের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানকার রক্তপাত, গণহত্যা ও অত্যাধিক ক্ষুধা সম্পর্কে প্রায় সব সতর্ক ঈমানদারগণই ওয়াকিবহাল। আর জুলাই ২০১৩ তে মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির পরে মিসরের রক্তপাত ও গণহত্যা সম্পর্কেও প্রায় সব সতর্ক ঈমানদারগণই ওয়াকিবহাল।
এখন অপেক্ষা নীলনদের করুনদশার। মিশরের সবচেয়ে বড় নদীটি হল নীলনদ। কিন্তু এটিরও উৎপত্তি আফ্রিকার উগান্ডা সেন্ট্রালের ভিক্টোরিয়া ঝিল। নীলনদের পানির সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল রুয়ান্ডা নদী। ২০১১ সালে ইথিউপিয়া সরকার ৪.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে “গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেজিস্টেন্স ড্যাম” নামে ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহমান নীল নদের উপর ড্যাম নির্মাণ শুরু করে, যার নির্মাণ কাজ শেষ হবার কথা ২০১৭ সালে।
শুরু থেকেই মিসরের সরকার অতি নির্ভরশীল নীল নদের উপর এই ড্যাম নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে। সর্বশেষ ৩রা জুন ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট মুরসি প্রয়োজনে এই ড্যাম ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধ করার ঘোষণা দেন এবং এর কয়েক সপ্তাহ পরেই ক্ষমতাচ্যুত হন।
হযরত ওহব ইবনে মুনব্বিহ সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
“মিশর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত জাজিরাতুল আরব (বর্তমান সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও ইয়েমেন) নিরাপদ থাকবে। কুফা (বর্তমান ইরাকে) ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে না। মহাযুদ্ধ সংগঠিত হয়ে গেলে বনু হাশিমের এক ব্যক্তির হাতে কুস্তুন্তুনিয়া (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় হবে। ইরাক ধ্বংস হবে ক্ষুধা ও তরবারির (যুদ্ধের) কারণে, কুফা ধ্বংস হবে শত্রুর দিক থেকে। বসরা ধ্বংস হবে নিমজ্জনের কারণে”। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৮৮৫)
এখানেও মহাযুদ্ধের পূর্বে সর্বপ্রথম মিশর ও ইরাকের ধ্বংস বা ক্ষতির কথা বলা হয়েছে এবং এই ভূখণ্ডগুলোর (ইরাক ও মিশর) ধ্বংস বা ক্ষতির আগ পর্যন্ত জাজিরাতুল আরব (বর্তমান সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমান ও ইয়েমেন) এর নিরাপদে থাকার কথা বলা হয়েছে। আর এই জাজিরাতুল আরবেই মুসলিম বিশ্বের দুই প্রাণ প্রিয় নগরী মক্কা ও মদিনা অবস্থিত।
এখন আমরা একটু বুঝার চেষ্টা করি, যেই কুফা নগরীর ধ্বংসের পরে ইমাম মাহদির নেতৃত্বে রোমানদের (খ্রিস্টানদের) সাথে মহাযুদ্ধ হবে, কখন সেই কুফা নগরী ধ্বংস হবে?
যদিও ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের আগে সিরিয়ার কাল্ব গোত্রীয় কুরায়শী শাসক (হাদিসে ‘সুফিয়ানি’ উপাধি হিসাবে এসেছে) কুফায় খোরাসান থেকে আগত কালো পতাকা বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং পরবর্তীতে ইমাম মাহদির নেতৃত্বে কাল্বের যুদ্ধে পরাজিত করে সুফিয়ানিকে তারবিয়া হ্রদের নিকটে তাকে হত্যা করা হবে, কিন্তু কুফা নগরীর মূল ধ্বংস আসবে মুসলমানদের সাথে রোমানদের (খ্রিস্টানদের) শান্তি/সন্ধি চুক্তির পড়ে। হাদিসের আলোকে ঘটনার ধারাবাহিকতা নিম্নরূপঃ
ইমাম মাহদির আগমনের ঠিক পূর্ব হতে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে উনার অবস্থানকালীন ও নেতৃত্বাধীন সকল যুদ্ধের ধারাবাহিক বর্ণনা সহকারে ইয়াজুজ মাজুজ হয়ে কিয়ামতের সমস্ত আলামত বর্ণনা করে হযরত হুজায়ফা (রাঃ) এর সুবিস্তৃত হাদিসে কাল্বের যুদ্ধে সুফিয়ানিকে পরাজিত করে তারবিয়া হ্রদের নিকটে তাকে হত্যা করার পরের ঘটনা যে ভাবে বর্ণিত হয়েছে,
“ইমাম মাহদি মুমিনদের সঙ্গে নিয়ে রওনা হবে এবং দামেস্কে পৌঁছে যাবে। তারপর মহান আল্লাহপাক এক রোমানকে (খৃষ্টানকে) তার প্রতি প্রেরণ করবেন। তোমরা সাত বছরের জন্য (কোনও বর্ণনায় এসেছে দশ বছর) তার সাথে চুক্তি করবে”। (আসসুনানুল ওয়ারিদাতুল ফিল ফিতান, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১০)
হযরত যু-মিখবার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“অদূর ভবিষ্যতে তোমরা রোমানদের (খ্রিস্টানদের) সাথে শান্তি চুক্তি করবে। পরে তোমরা ও তারা (খ্রিস্টানরা) মিলে তোমাদের পিছন দিককার সাথে যুদ্ধ করবে। সেই যুদ্ধে তোমরা জয়ী হবে, গনিমত অর্জন করবে এবং নিরাপত্তা লাভ করবে। তখন এক খৃষ্টান ব্যক্তি ক্রুশ উঁচিয়ে ধরে বলবে, ক্রুশ জয়ী হয়ে গেছে। ফলে মুসলমানদের এক ব্যক্তি তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে ক্রুশটিকে ভেঙ্গে ফেলবে। এই ঘটনার সুত্র ধরে রোমানরা (খ্রিস্টানরা) বিশ্বাসঘাতকতা (সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ) করবে”। (মিশকাত শরীফ, মহাযুদ্ধ অধ্যায়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
“তখন রোমানরা তাদের রাজাকে বলবে, আরববাসীদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে আমরাই যথেষ্ট। ফলে তারা যুদ্ধের (মহাযুদ্ধের) জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে এবং তারা আশিটি পতাকার তলে সমবেত হবে। আর প্রতিটি পতাকার তলে বারো হাজার করে সৈন্য থাকবে”। (সহিহ ইবনে হিব্বান, মুসতাদরাকে হাকেম)
সন্ধি চুক্তির পর মুসলমান ও রোমানরা মিলে পেছনের দিককার শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) ‘পেছনের দিককার শত্রুপক্ষ’ কথাটির বিশ্লেষণ করেছেন যে,
“তোমাদের পিছনের দিককার মানে কুনুস্তুন্তুনিয়ার (বর্তমানে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের) পেছনের দিককার শত্রু (মানচিত্র অনুযায়ী বর্তমান রাশিয়া)”। (আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৩৮)
ইউনুস বিন সাইফ আল খুলানি আল ফিতানের অপর বর্ণনায় বলেছেন,
“তোমরা রোমানদের (খৃষ্টানদের) সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। এরপরে তোমরা একত্রে ‘টার্কস’ (বর্তমান রাশিয়া) এবং কারমান (ইরানের একটি প্রদেশ) আক্রমণ করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে জয়ী করবেন”।
হযরত কা’ব (রাঃ) আল ফিতানের অপর বর্ণনায় বলেছেন,
“তোমরা দশ বছরের জন্য (কোনও বর্ণনায় এসেছে সাত বছর) রোমানদের সাথে সন্ধি চুক্তি করবে। তোমরা এবং রোমানরা মিলে কুস্তুন্তুনিয়ার (বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলের) পেছনের দিককার শত্রুর (মানচিত্র অনুযায়ী বর্তমান রাশিয়ার) সাথে যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ শেষে ফেরার সময় তোমরা কুস্তুন্তুনিয়া দেখতে পাবে। এবার তোমরা এবং রোমানরা মিলে কুফা নগরী আক্রমণ করবে এবং একে ধ্বংস করে ফেলবে। এরপরে তোমরা এবং রোমানরা মিলে পূর্বের কিছু এলাকা (বর্তমান ইরান) আক্রমণ করবে”।
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ (রাঃ) আল ফিতানের অপর বর্ণনায় বলেছেন,
“মুসলমান ও রোমানদের (খ্রিস্টানদের) মধ্যে এমনভাবে সন্ধি চুক্তি হবে যে তারা একত্রে পেছনের দিককার শত্রুর (মানচিত্র অনুযায়ী বর্তমান রাশিয়ার) সাথে যুদ্ধ করবে এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিজেরা ভাগ করে নিবে। এরপর রোমানরা মুসলমানদের সাথে একত্রে পারস্য (বর্তমান ইরান) আক্রমণ করবে”।
হযরত কা’ব (রাঃ) রোমানদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন,
“তোমরা রোমানদের (খ্রিস্টানদের) সাথে সন্ধি চুক্তি করবে। এবার তোমরা এবং রোমানরা মিলে কুফা নগরী আক্রমণ করবে আর এটাই এই নগরীর ধ্বংসের কারণ হবে”। (আল ফিতান, পৃষ্ঠা ২৯৬)
হাকিম ইবনে উমর বলেন,
“রোমানরা (খ্রিস্টানরা) সন্ধি চুক্তির প্রস্তাব করবে। আর এটাই কুফা নগরীর ধ্বংসের কারণ হবে”। (আল ফিতান, পৃষ্ঠা ২৬৮)
সুতরাং ধারাবাহিকতা যা বোঝা গেল,
- মাহদি (আত্ম প্রকাশের পূর্বে) ও ‘মনসুর’ (খোরাসানের কালো পতাকাবাহী বাহিনীর এক সেনাপতি) এর কুফা গমন
- কুফা থেকে হজ্জের মওসুমে মদিনা হয়ে মক্কা গমন
- হজ্জচলা কালীন মিনাতে রক্তাক্ত সংঘাতের পরে ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ ও খোরাসানের কালো পতাকাবাহী বাহিনীর বাইয়াত প্রদান
- বায়দায় সৈন্য বাহিনীর ধ্বসে যাওয়া
- এর পরে মক্কাতে এসে সিরিয়ার ‘আবদালগণ (শ্রেষ্ঠ মুসলমানগণ)’ ও ইরাকের ‘আসাইব (সম্মানিত মুসলমান)’ দের বাইয়াত প্রদান
- খোরাসানের কালো পতাকাবাহী বাহিনী, সিরিয়ার ‘আবদালগণ’ ও ইরাকের ‘আসাইবগণ’ সহ ইমাম মাহদির কুফায় ফিরে আসা
- সেখান থেকে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা
- সিরিয়ার কাল্ব গোত্রীয় শাসকের সাথে ‘কাল্বের যুদ্ধ’ ও তাকে তারবিয়া হ্রদের নিকট হত্যা রোমানদের সাথে সন্ধি চুক্তি
- কুস্তুন্তুনিয়ার (ইস্তাম্বুলের) পেছন দিককার শত্রুর (রাশিয়ার) সাথে মুসলমান ও রোমানদের যুদ্ধ জয়
- মুসলমান ও রোমানদের কুফায় আগমন ও নগরী ধ্বংস
- মুসলমান ও রোমানদের পারস্য (বর্তমান ইরান) আক্রমণ ও জয়
- রোমানদের সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ
- রোমানদের সাথে মহাযুদ্ধ
বর্তমানে সিরিয়ার বনু কাল্ব গোত্রের এই শাসকের সাথে রাশিয়া ও ইরানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। এই দুই ভূখণ্ড সরাসরি কূটনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি এই বাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। এমনকি এই দুই ভূখণ্ডের সৈন্যরা সরাসরি তার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। কুয়েতের আরবী সংবাদপত্র আস-সিয়্যাসসার বরাত দিয়ে অনলাইন নিউজ পেপার www.kavkazcenter.com গত ২২ শে নভেম্বর ২০১৩ তারিখে Russians participate in battle for Syrian district নামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আর রয়টার্সের অন লাইন সংস্করণ www.reuters.com এ গত ৪ ঠা নভেম্বর ২০১৩ তারিখের Iran Revolutionary Guards commander killed in Syria নামক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
হযরত হুজায়ফা (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত হাদিসে আছে, আ’মাক যুদ্ধে আল্লাহ কাফেরদের উপর উপর ফোরাতের কূল থেকে খোরাসানি ধনুকের সাহায্যে তীর বর্ষণ করবে।
অথচ আ’মাক (সিরিয়ায় আলেপ্পোতে তুরস্কের সীমানার কাছাকাছি গ্রাম) থেকে ফোরাত (ইরাকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী, তুরস্ক থেকে উৎপত্তি) এর নিকটতম তীরের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। সাধারণ কোন তীর ধনুকের দ্বারা ৭৫ কিলোমিটার পার হওয়া সম্ভব নয়। এখানে ধনুকের উদ্দেশ্য তোপ বা ইংরেজিতে “ল্যান্ড টু ল্যান্ড মিজাইল” হতে পারে।
যদিও পশ্চিমা মিডিয়া ও একশ্রেণীর অতি সমঝদার মুসলিম নামধারী বিশ্লেষক যারা ইসলামের ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে জ্ঞানশূন্য, একে তৈলক্ষেত্র দখল, আঞ্চলিক রাজনীতি, এই পক্ষ সেই পক্ষ বিষয়ক ঘটনা হিসাবে সারা মুসলিম জাহানে উপস্থাপন করেছে। অথচ এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিশাল সতর্কবাণী।
যেহেতু হাদিসে বর্ণিত সিরিয়ার বনু কাল্ব গোত্রীয় অত্যাচারী শাসককে ইমাম মাহদি নিজে হত্যা করবেন আর ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ হবে হজ্জের মৌসুমে মিনাতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে, তাই বর্তমান শাসক যতদিন বেঁচে থাকবে (মারা গেলে বুঝা যাবে এই শাসক হাদিসে বর্ণিত সেই শাসক নয়), আমরা ততদিন সমগ্র ইরাক, সিরিয়া, খোরাসান ও জাজিরাতুল আরবের ভূখণ্ডগুলোর প্রতিটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সর্বোপরি সামরিক পরিস্থিতির উপর।
লেখককে ফলো করুন
|
© 2013 by Ask Islam Bangla.