আল্লাহ তা’আলা কোথায় আছেন ?
বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে খুব বড় ঝগড়ার মধ্যে পরে যাচ্ছে অল্প জ্ঞানী মুসলিমরা আর সাধারন মানুষরা উভয় পক্ষের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন কেননা তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না যে কে সঠিক কে ভুল, তাই এই আর্টিকেলটি ইন শা আল্লাহ তাদের উপকার করবে যারা হক বা সঠিক মতটি জানতে ও মানতে চায়।
আল্লাহ তা’আলা কোথায় আছেন? এটি ৩ স্তরে আমি এখানে প্রমান করেছি, ১ম স্তরটি হলঃ আল-কোরআন ও তাফসীর ইবন কাসীর, ২য় স্তরটি হলঃ সহীহ হাদীস এবং ৩য় স্তরটি হলঃ সালাফে সালেহীন এবং ইমাম ও মুজতাহীদগনের বানী।
কোরআনের আয়াত ও তাফসীর ইবন কাসীর হতে দলীলঃ
১. নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । (সুরা আরাফ: ৫৪)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “আসমান ও জমিনকে আল্লাহ ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, এই ছয় দিনের ব্যস্ততার পর আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর সমাসীন হন। আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন এ স্থানে লোকেরা বহু মতামত পেশ করেছেন বহু জল্পনা-কল্পনা করেছেন। এগুলর ব্যাখ্যা দেওয়ার সুজোগ এখানে নেই। এ ব্যাপারে আমরা শুধু মাত্র পূর্ববর্তী সহীহ আমলকারী বিজ্ঞজনদের মতামত অবলম্বন করেছি। তারা হচ্ছেন ইমাম মালিক, আওযায়ী, সাউরী,লায়েস ইবন সাদ, শাফিঈ, আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক ইবন রাহওয়াহ এবং ইসলামের নবীন ও প্রবীন গ্রহণযোগ্য মুসলিম ইমামগন। আর তাদের মতামত হচ্ছে এই যে, কোন রকম সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই এইটার(আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার) উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। মোট কথা যা কিছু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ওইটাকে কোন খেয়াল ও সন্দেহ ছাড়াই মেনে নিতে হবে এবং কোন চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা চলবে না” [1]
অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন তিনি আরশে সুতরাং কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই মেনে নিতে হবে যে আল্লাহ আরশে সমাসীন এবং আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার কোন সাদৃশ্য ও কল্পনা করা যাবে না কেননা কোন কিছুই তার মত নয়।
২. রহমান (আল্লাহ্) আরশে সমুন্নত (সূরা ত্ব-হা: ৫)
৩. তেমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছো যে, যিনি আকাশে অবস্থিত রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন না। (সুরা মূলক:১৬)
৪. বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকটে উত্তলন করে নিয়েছেন। (সূরা নিসাঃ ১৫৮)
৬. নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের প্রতিপালক, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সুরা ইয়উনুসঃ ৩)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেনঃ “অতপর আল্লাহ তা’আলা বড় আরশের উপর সমাসীন হয়ে গেলেন। আরশ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৃষ্টবস্তু” [2]
৭. তিনি আকাশমণ্ডলী,পৃথিবীকে এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিবসে সৃষ্টি করেন: অতপর তিনি আরশে সমাসীন হন: তিনি রহমান, তার সম্মন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। (সুরা ফুরকানঃ ৫৯)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “তিনি সবকিছুর সৃষ্টি কর্তা ও অধিপতি। তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমান যমীনের মত বিরাট মাখলুককে মাত্র ৬ দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। কার্যাবলী তদবীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে” [3]
সহীহ হাদীস হতে দলীলঃ
১. তোমরা কি আমাকে আমানতদার মনে কর না, অথচ যিনি আসমানে আছেন আমি তাঁর আমানতদার। আমার কাছে আসমানের খবর সকাল- সন্ধ্যায় আসে।[4]
২. মুয়াবিয়া ইবন হাকাম আস-সুলামী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক দাসীকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ ‘আল্লাহ কোথায়’ উত্তরে সে বলেছিলঃ আল্লাহ আসমানে। তিনি বললেন, আমি কে? সে বললঃ আপনি আল্লাহ রাসূল। তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মনিবকে বললেন তাকে আজাদ করে দেয়। কেননা সে ঈমানদার। [5]
৩. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যারা যমিনে আছে তোমরা তাদের প্রতি দয়াশীল হও যিনি আকাশে আছেন তিনি তমাদের প্রতি দয়াশীল হবেন’। [6]
৪. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন) বলেছেন, “প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিব”। [7]
সালাফে সালেহীন এবং ইমাম ও মুজতাহীদ এর বানী হতে দলীলঃ
১. আমীরুল মুমিনীন আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছনেঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমানের উপর জীবিত আছেন, কখনোই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন না। [8]
২. ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমিনে আছেন,তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে, কেননা আল্লাহ বলেন- রহমান আরশে সমাসীন। আর তার আরশ শপ্ত আকাশের উপর। [9]
৩. ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমরা এবং তাবেয়ীগন বলেন যে, অবশ্যই আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি তার আরশের উপর, এবং তার গুন(সিফাত) সম্পর্কে যা সুন্নাহ এ বর্ণিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি। [10]
৪. ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশের উপর আর তার জ্ঞানের পরিধি সর্বব্যাপী বিস্তৃত। [11]
৫. ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমি যে তরিকার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যাদেরকে ঐ তরিকার উপর পেয়েছি সুফিয়ান সাওরী,মালিক প্রমখগন তা হল এই কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রাসুল আর আল্লাহ তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন। তিনি তার বান্দার নিকটবর্তী হন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন এবং যে ভাবে চান ঠিক সে ভাবেই দুনিয়ার আকাশে অবতরন করেন। [12]
৬. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) এর পুত্র ইমাম আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমার বাবাকে (ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) জিজ্ঞাসা করা হল যে, আল্লাহ তার সৃষ্টি থেকে দূরে সপ্তম আকাশের উপরে তার আরশে সমাসীন। তাঁর ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিধি সর্বত্র বিস্তৃত। এর উত্তরে তিনি(ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) বলেছেনঃ হ্যাঁ, তিনি(আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন এবং তার জ্ঞানের বহির্ভূত কিছুই নেই। [13]
৭. ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ উলামাদের(আলেমদের) ইজমা এই যে, আল্লাহ আরশের উপর। [14]
৮. উসমান ইবন সাঈদ আল-দারিমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ এবং মুসলিমগণ একমত পোষণ করেছেন যে আল্লাহ তার আরশের উপর। [15]
৯. ইমাম আলী ইবন আল-মাদিনী (রাহিমাহুল্লাহ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর আকীদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, তিনি জবাবে বলেছিলেনঃ তারা(আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ) বিশ্বাস করে যে আল্লাহ জান্নাতের উপর, তার আরশের উপর। [16]
১০. ইমাম ইবন খুযাইমা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি স্বীকার করে না যে আল্লাহ্ তাআলা সপ্তাকাশে স্বীয় আরশে সমুন্নত, সৃষ্টি জগত হতে সম্পূর্ণ আলাদা- সে কাফের। তাকে তওবা করার নির্দেশ দিতে হবে। তওবা না করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অতঃপর তার লাশ ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে হবে যাতে করে কিবলা ওয়ালা মুসলমানগণ এবং কর প্রদানকারী অমুসলিমগণ তার দূর্গন্ধে কষ্ট না পায়। [17]
১১. শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশে সমুন্নত রয়েছেন। রাজত্ব নিজ আয়ত্তে রেখেছেন। সমস্ত বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছেন। আর এভাবে তার পরিচয় দেওয়া জায়েজ নয় যে, তিনি প্রত্যেক স্থানে বিরাজমান: বরং বলতে হবে তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন যেমনটি তিনি(নিজেই) বলেছেনঃ ‘রহমান আরশে সমুন্নত’।
স্বাভাবিক ভাবেই এইকথা বলতে হবে, কোন প্রকার অপব্যাখ্যা করে নয়। তিনি যে আসমানে আছেন একথা নবী-রাসুলদের প্রতি নাজিলকৃত প্রত্যেক কিতাবেই লিখিত আছে। তবে আরশে তিনি কিভাবে রয়েছেন তার পদ্ধতি কারো জানা নেই।[18]
১২. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আমি তাদের(জাহমিয়া) জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমরা প্রত্যাখ্যান করো আল্লাহর আরশে থাকাকে। তাহলে কেন আল্লাহ বলেছেনঃ ‘দয়াময় আল্লাহ আরশে সমাসীন হয়েছেন’? (সুরা ত্বহাঃ ৫)
তারা বললঃ ‘তিনি আরশের উপরও আছেন, ৭ আসমানের উপরেও আছেন, ৭ আসমানের নিচেও আছেন এবং তিনি এই পৃথিবীতেও আছেন’
আমি(ইমাম আহমাদ) জবাব দিলামঃ “ মুসলিমরা জানে অনেক জায়গায় আল্লাহ থাকা তাঁর মহিমার বিরুদ্ধে, যেমন তোমাদের শরীর, তোমাদের পেটে থাকা, টয়লেটে থাকা , পতিতালয়ে থাকা , এইরূপ জায়গায় থাকা আল্লাহর মহান মর্যাদার বিরুদ্ধে। এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন তিনি আকাশে আছেন এই আয়াত গুলোর মাধ্যমে"। [19]
[1]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ড- ৮-১১, সূরা আরাফ-৫৪
[2]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ৮-১১, সুরা ইউনুস আয়াত-৩
[3]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ১৫, সুরা ফুরকান আয়াত-৫৯
[4] . সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[5] . সহীহ মুসলিম
[6] . জামে তিরমিযী
[7] . সহীহ বুখারী, হাদীসঃ ১১৪৫ ; সহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ৭৫৮ ; সুনানে আবু দাউদ, হাদীসঃ ১৩১৫
[8] . সুনানে দারেমী, সনদ সহীহ ; আত-তারীখ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২০২ ; ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ৮৩৮৪
[9] . শারহ আকীদাতিত তাহাবীয়াহ, পৃঃ ৩২২
[10] . ইমাম বাইহাকী এর আল আসমা ওয়া সিফাত, পৃঃ ৫১৫
[11] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১০১
[12] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১২২
[13] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১৫২-১৫৩
[14] . আল-উলু, পৃঃ ১৩২
[15] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ২১৩
[16] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ১৮৯
[17] . মুখতাসার আল-উলু
[18] . গুনিয়াতুত ত্বলিবীন
[19] . ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল এর আর রা’দ আলা আল জাহমিয়া, পৃঃ ৯২-৯৩
[ লেখক : Mainuddin Ahmed ]
আল্লাহ তা’আলা কোথায় আছেন? এটি ৩ স্তরে আমি এখানে প্রমান করেছি, ১ম স্তরটি হলঃ আল-কোরআন ও তাফসীর ইবন কাসীর, ২য় স্তরটি হলঃ সহীহ হাদীস এবং ৩য় স্তরটি হলঃ সালাফে সালেহীন এবং ইমাম ও মুজতাহীদগনের বানী।
কোরআনের আয়াত ও তাফসীর ইবন কাসীর হতে দলীলঃ
১. নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । (সুরা আরাফ: ৫৪)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “আসমান ও জমিনকে আল্লাহ ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, এই ছয় দিনের ব্যস্ততার পর আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর সমাসীন হন। আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন এ স্থানে লোকেরা বহু মতামত পেশ করেছেন বহু জল্পনা-কল্পনা করেছেন। এগুলর ব্যাখ্যা দেওয়ার সুজোগ এখানে নেই। এ ব্যাপারে আমরা শুধু মাত্র পূর্ববর্তী সহীহ আমলকারী বিজ্ঞজনদের মতামত অবলম্বন করেছি। তারা হচ্ছেন ইমাম মালিক, আওযায়ী, সাউরী,লায়েস ইবন সাদ, শাফিঈ, আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক ইবন রাহওয়াহ এবং ইসলামের নবীন ও প্রবীন গ্রহণযোগ্য মুসলিম ইমামগন। আর তাদের মতামত হচ্ছে এই যে, কোন রকম সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই এইটার(আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার) উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। মোট কথা যা কিছু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ওইটাকে কোন খেয়াল ও সন্দেহ ছাড়াই মেনে নিতে হবে এবং কোন চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা চলবে না” [1]
অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন তিনি আরশে সুতরাং কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই মেনে নিতে হবে যে আল্লাহ আরশে সমাসীন এবং আল্লাহ আরশে সমাসীন এইটার কোন সাদৃশ্য ও কল্পনা করা যাবে না কেননা কোন কিছুই তার মত নয়।
২. রহমান (আল্লাহ্) আরশে সমুন্নত (সূরা ত্ব-হা: ৫)
৩. তেমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছো যে, যিনি আকাশে অবস্থিত রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন না। (সুরা মূলক:১৬)
৪. বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকটে উত্তলন করে নিয়েছেন। (সূরা নিসাঃ ১৫৮)
৬. নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের প্রতিপালক, যিনি আকাশ সমূহ এবং পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সুরা ইয়উনুসঃ ৩)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেনঃ “অতপর আল্লাহ তা’আলা বড় আরশের উপর সমাসীন হয়ে গেলেন। আরশ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৃষ্টবস্তু” [2]
৭. তিনি আকাশমণ্ডলী,পৃথিবীকে এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিবসে সৃষ্টি করেন: অতপর তিনি আরশে সমাসীন হন: তিনি রহমান, তার সম্মন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। (সুরা ফুরকানঃ ৫৯)
তাফসীরঃ ইমাম ইবন কাসীর বলেছেনঃ “তিনি সবকিছুর সৃষ্টি কর্তা ও অধিপতি। তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমান যমীনের মত বিরাট মাখলুককে মাত্র ৬ দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। কার্যাবলী তদবীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে” [3]
সহীহ হাদীস হতে দলীলঃ
১. তোমরা কি আমাকে আমানতদার মনে কর না, অথচ যিনি আসমানে আছেন আমি তাঁর আমানতদার। আমার কাছে আসমানের খবর সকাল- সন্ধ্যায় আসে।[4]
২. মুয়াবিয়া ইবন হাকাম আস-সুলামী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনৈক দাসীকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ ‘আল্লাহ কোথায়’ উত্তরে সে বলেছিলঃ আল্লাহ আসমানে। তিনি বললেন, আমি কে? সে বললঃ আপনি আল্লাহ রাসূল। তখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মনিবকে বললেন তাকে আজাদ করে দেয়। কেননা সে ঈমানদার। [5]
৩. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যারা যমিনে আছে তোমরা তাদের প্রতি দয়াশীল হও যিনি আকাশে আছেন তিনি তমাদের প্রতি দয়াশীল হবেন’। [6]
৪. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন) বলেছেন, “প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছ যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আছ যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দিব”। [7]
সালাফে সালেহীন এবং ইমাম ও মুজতাহীদ এর বানী হতে দলীলঃ
১. আমীরুল মুমিনীন আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছনেঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আসমানের উপর জীবিত আছেন, কখনোই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন না। [8]
২. ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমিনে আছেন,তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে, কেননা আল্লাহ বলেন- রহমান আরশে সমাসীন। আর তার আরশ শপ্ত আকাশের উপর। [9]
৩. ইমাম আওযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমরা এবং তাবেয়ীগন বলেন যে, অবশ্যই আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি তার আরশের উপর, এবং তার গুন(সিফাত) সম্পর্কে যা সুন্নাহ এ বর্ণিত হয়েছে তা আমরা বিশ্বাস করি। [10]
৪. ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশের উপর আর তার জ্ঞানের পরিধি সর্বব্যাপী বিস্তৃত। [11]
৫. ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমি যে তরিকার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যাদেরকে ঐ তরিকার উপর পেয়েছি সুফিয়ান সাওরী,মালিক প্রমখগন তা হল এই কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রাসুল আর আল্লাহ তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন। তিনি তার বান্দার নিকটবর্তী হন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন এবং যে ভাবে চান ঠিক সে ভাবেই দুনিয়ার আকাশে অবতরন করেন। [12]
৬. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) এর পুত্র ইমাম আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আমার বাবাকে (ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) জিজ্ঞাসা করা হল যে, আল্লাহ তার সৃষ্টি থেকে দূরে সপ্তম আকাশের উপরে তার আরশে সমাসীন। তাঁর ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিধি সর্বত্র বিস্তৃত। এর উত্তরে তিনি(ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল) বলেছেনঃ হ্যাঁ, তিনি(আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন এবং তার জ্ঞানের বহির্ভূত কিছুই নেই। [13]
৭. ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ উলামাদের(আলেমদের) ইজমা এই যে, আল্লাহ আরশের উপর। [14]
৮. উসমান ইবন সাঈদ আল-দারিমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ এবং মুসলিমগণ একমত পোষণ করেছেন যে আল্লাহ তার আরশের উপর। [15]
৯. ইমাম আলী ইবন আল-মাদিনী (রাহিমাহুল্লাহ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ এর আকীদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, তিনি জবাবে বলেছিলেনঃ তারা(আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাহ) বিশ্বাস করে যে আল্লাহ জান্নাতের উপর, তার আরশের উপর। [16]
১০. ইমাম ইবন খুযাইমা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি স্বীকার করে না যে আল্লাহ্ তাআলা সপ্তাকাশে স্বীয় আরশে সমুন্নত, সৃষ্টি জগত হতে সম্পূর্ণ আলাদা- সে কাফের। তাকে তওবা করার নির্দেশ দিতে হবে। তওবা না করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। অতঃপর তার লাশ ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে হবে যাতে করে কিবলা ওয়ালা মুসলমানগণ এবং কর প্রদানকারী অমুসলিমগণ তার দূর্গন্ধে কষ্ট না পায়। [17]
১১. শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আল্লাহ আরশে সমুন্নত রয়েছেন। রাজত্ব নিজ আয়ত্তে রেখেছেন। সমস্ত বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছেন। আর এভাবে তার পরিচয় দেওয়া জায়েজ নয় যে, তিনি প্রত্যেক স্থানে বিরাজমান: বরং বলতে হবে তিনি আসমানে আরশের উপর রয়েছেন যেমনটি তিনি(নিজেই) বলেছেনঃ ‘রহমান আরশে সমুন্নত’।
স্বাভাবিক ভাবেই এইকথা বলতে হবে, কোন প্রকার অপব্যাখ্যা করে নয়। তিনি যে আসমানে আছেন একথা নবী-রাসুলদের প্রতি নাজিলকৃত প্রত্যেক কিতাবেই লিখিত আছে। তবে আরশে তিনি কিভাবে রয়েছেন তার পদ্ধতি কারো জানা নেই।[18]
১২. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আমি তাদের(জাহমিয়া) জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমরা প্রত্যাখ্যান করো আল্লাহর আরশে থাকাকে। তাহলে কেন আল্লাহ বলেছেনঃ ‘দয়াময় আল্লাহ আরশে সমাসীন হয়েছেন’? (সুরা ত্বহাঃ ৫)
তারা বললঃ ‘তিনি আরশের উপরও আছেন, ৭ আসমানের উপরেও আছেন, ৭ আসমানের নিচেও আছেন এবং তিনি এই পৃথিবীতেও আছেন’
আমি(ইমাম আহমাদ) জবাব দিলামঃ “ মুসলিমরা জানে অনেক জায়গায় আল্লাহ থাকা তাঁর মহিমার বিরুদ্ধে, যেমন তোমাদের শরীর, তোমাদের পেটে থাকা, টয়লেটে থাকা , পতিতালয়ে থাকা , এইরূপ জায়গায় থাকা আল্লাহর মহান মর্যাদার বিরুদ্ধে। এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন তিনি আকাশে আছেন এই আয়াত গুলোর মাধ্যমে"। [19]
[1]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ড- ৮-১১, সূরা আরাফ-৫৪
[2]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ৮-১১, সুরা ইউনুস আয়াত-৩
[3]. তাফসীর ইবন কাসীর; খণ্ডঃ ১৫, সুরা ফুরকান আয়াত-৫৯
[4] . সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[5] . সহীহ মুসলিম
[6] . জামে তিরমিযী
[7] . সহীহ বুখারী, হাদীসঃ ১১৪৫ ; সহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ৭৫৮ ; সুনানে আবু দাউদ, হাদীসঃ ১৩১৫
[8] . সুনানে দারেমী, সনদ সহীহ ; আত-তারীখ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২০২ ; ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ৮৩৮৪
[9] . শারহ আকীদাতিত তাহাবীয়াহ, পৃঃ ৩২২
[10] . ইমাম বাইহাকী এর আল আসমা ওয়া সিফাত, পৃঃ ৫১৫
[11] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১০১
[12] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১২২
[13] . ইজমিয়াউল জুয়ুশীল ইসলামিয়্যাহ, পৃঃ ১৫২-১৫৩
[14] . আল-উলু, পৃঃ ১৩২
[15] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ২১৩
[16] . মুখতাসার আল-উলু, পৃঃ ১৮৯
[17] . মুখতাসার আল-উলু
[18] . গুনিয়াতুত ত্বলিবীন
[19] . ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল এর আর রা’দ আলা আল জাহমিয়া, পৃঃ ৯২-৯৩
[ লেখক : Mainuddin Ahmed ]
© 2014 by Ask Islam Bangla.