নীড়ে ফেরা পাখিরা
১.
সকাল ৬ টা বাজে।
প্রায় আট বছরের একটা ছোট্ট সংসারের কর্ত্রী মুনা। সে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। একটু পরই সবাইকে ডেকে তুলতে হবে, নাস্তা খাওয়াতে হবে, বাবুকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে এবং সবশেষে যেতে হবে টুকিটাকি কিছু বাজার করতে। হাতে সময় নেই একদম।
বাবুকে স্কুলে দিয়ে মুনা প্রায়ই স্কুলের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে অনেক সময় স্কুলের গার্জিয়ানরা একসাথে গল্প করেন। মুনা কখনো কখনো সেই গল্পে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রায়ই সে গল্পের বিষয়বস্তুর জন্য পিছু হটতে বাধ্য হয়! বেশিরভাগ সময় গল্পের বিষয়বস্তু হয় অন্যের পরচর্চা ( অধিকাংশ সময়ে নিজ নিজ স্বামীর কিংবা শ্বশুরবাড়ির) কিংবা শাড়ি-গহনার গল্প। মুনা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আজকের গল্পের বিষয়বস্তু- টিভিতে কোন একটা সিরিয়ালের কোন একটা চরিত্র।
কিছুক্ষন সেই সিরিয়ালের নায়িকার দুঃখ, নায়কের দুর্ভাগ্য নিয়ে আলোচনা আর ভিলেনের মুন্ডুপাত করার পর একজন ভদ্রতাবশত মুনাকে জিজ্ঞেস করল- “ভাবি এই ব্যাপারে আপনি কি বলেন? ”
মুনা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল- “আমি তো এইসব দেখিনা। ভালো লাগেনা। ”
“বলেন কি? ” সবাই অবাক। “তাহলে বাসায় সময় কাটান কিভাবে? ”
“এতদিন পড়াশোনা করতাম, তখন সেটা নিয়েই সময় কেটে যেত। এখন পরিবারকে সময় দেই, বাবুর সাথে খেলি। বাবুর আব্বুর সাথে গল্প করি। আর একা একা থাকলে বই পড়ি, নিজে নিজে পড়াশোনার চেষ্টা করি, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি, হাতের কাজ করি। সময় কখন কেটে যায় টেরই পাইনা।” মুনা স্মিত হাসার চেষ্টা করে।
সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সে একটা এলিয়েন। সবাইকে সালাম দিয়ে মুনা তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচল। পিছনে কিছু মানুষের ফিসফিসানি শুনতে পেলো সে। মুনা সেসব কথায় কান দিলো না, কিন্তু তার একটু মন খারাপ হল।
এরপর সে গেল বাজারে। খুব দামি একটা সুপারশপ- কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সবকিছু পাওয়া যায়। যা যা দরকার তা কেনার ফাঁকে ফাঁকে তার হুট করে চোখ পরল একটা খুব সুন্দর একটা ব্যাগ এর দিকে- কি কিউট দেখতে! হালকা গোলাপি রঙ, তার একটা শাড়ির সাথে খুব সুন্দর মানাবে। এমন একটা ব্যাগ সে অনেকদিন ধরে খুঁজছে। এগিয়ে গিয়ে দাম দেখলো মুনা- দেখে একটু দমে গেল। না , চাইলেই কিনতে পারে সে, এমন কিছু বেশি নয়। এমনিতে সে যথেষ্ট শৌখিন। বইপত্র কেনার পাশাপাশি এইসব টুকটাক শখের জিনিস কিনতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু তার হুট করে মনে পড়ল- বাবুর একটা নতুন খেলনার শখ অনেকদিনের। আর এদিকে বাবুর আব্বুর একটা মানিব্যাগ দরকার। এত্ত ভুলোমনা মানুষটা- আগেরটা ছিঁড়ে গেছে কিন্তু এখনো সেটা নিয়েই ঘুরছে! মুনার একটু রাগ হল।
সেই রাগমিশ্রিত মমতা নিয়ে মুনা খেলনা আর ছেলেদের মানিব্যাগের সেকশনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার মনেই রইল না ব্যাগটার কথা।
২.
আরিফ তার অফিসের ডেস্কে বসে আছে।
তার ইচ্ছে করছিল মাথার চুল ছিঁড়তে। সারাদিন ধরে কি একটা হিসেব সে কিছুতেই মিলাতে পারছে না। অফিসের বড়সাহেব কিছুক্ষন আগে একবার ঘুরে গেলেন। তার চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যে বলছেন- একটা সামান্য হিসাব ও মিলাতে পারেন না! আরিফের খুব লজ্জাও হচ্ছিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এটা তার ভুল নয়- অন্য কোথাও কোন একটা গণ্ডগোল আছে। সে আল্লাহকে স্মরণ করলো।
এইদিকে জোহরের সালাতের সময় হয়ে গিয়েছে। সে উঠে পড়লো। পাশেই কলিগরা দেশের রাজনীতি অথবা ফুটবল এই ধরনের কোন একটা আলোচনা নিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডায় লিপ্ত। আরিফ কয়েকজনকে সালাতে যাওয়ার জন্য ডাকলো- প্রতিদিনই ডাকে। কেউ শোনে, কেউ শোনেনা। ফলস্বরূপ, তার কপালে জোটে “হুজুর” তকমা।
অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাস ধরতে হবে। হাতে এখনো কিছু সময় আছে। হুট করে আরিফের চোখে পড়ল- একটা দোকানের সাজিয়ে রাখা গোলাপি রঙের কি মিষ্টি দেখতে একটা পার্স! কাচের স্বচ্ছ দেয়ালের বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল- মুনা অনেকদিন ধরে এরকম একটা ব্যাগ খুঁজছে। কোনকিছু না ভেবেই ব্যাগটা কিনে ফেলল আরিফ । মাসের মাঝামাঝি সময়, একটু হিসেব করে চলা উচিত। সে পাত্তা দিলো না, যদি ব্যাগটা পরে আর না পাওয়া যায়! হাজার হলেও মেয়েটার অনেকদিনের শখ। সাথে কিছু ফুল আর বাবুর জন্য চকলেটও কিনে নিল। কেন জানি খুব খুশি খুশি লাগছিল তার।
বাস এসে পরেছে। আরিফ বাসে উঠে ভাড়া দেওয়ার সময় আবিষ্কার করলো- তার পকেটে মানিব্যাগটা নেই। সেখানে টাকা বেশি ছিলনা- একটু আগে জিনিসপত্র কিনে খরচ করে ফেলেছে! গুরুত্বপূর্ণ কাগজ বলতে আইডি কার্ডটা ছিল। সেটা পাওয়ার কোন একটা ব্যবস্থা করা যাবে, সে আল্লাহর উপর ভরসা রাখলো। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন ভালো উদ্দেশ্য আছে। বরং সে খুশি হল- একটা আগে কেনা ব্যাগ, চকলেট এগুলো এখনো তার হাতে আছে! আলহামদুলিল্লাহ।
৩.
ছোট্ট মেয়ে মুনিয়া, সে স্কুলে অনেক ছোট্ট ক্লাসে পড়ে । কিন্তু ক্লাস ছোট হলে কি হবে, তাদের পড়ার চাপ যথেষ্ট। আজকে তাদের ম্যাথ টেস্ট ছিল। অনেক পরিশ্রম করে এসেছিল সে, কিন্তু পরীক্ষা সে তুলনায় ভালো হয়নি! যদিও ক্লাসের মিস কিচ্ছু বলেননি, তবুও মুনিয়ার মন খারাপ হল।
মন খারাপ হওয়ার একটা কারণ- সে তার বন্ধু টুনটুনির জন্য একটা কার্ড বানিয়ে এনেছিল। রঙিন কাগজ, আর তার মধ্যে ক্রেয়ন দিয়ে ফুল পাতা আঁকা। অনেক শখকরে লুকিয়ে কার্ড টা বানিয়ে এনেছিল সে, প্রাণের বান্ধবী টুনটুনি কে সারপ্রাইজ দেবার জন্য। কিন্তু টুনটুনি বলেছে- কার্ডটা নাকি একটুও ভালো হয়নি। এর চেয়ে ঢের ভাল কার্ড নাকি সে নিজেই বানাতে পারে।
অভিমানে মুনিয়ার চোখ ভিজে উঠল। চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো সে। আজকের দিনটা এত্ত খারাপ কেন?
৪.
সন্ধ্যা ছয়টা।
বাসার সবাই বসেছে সন্ধ্যাকালীন চা খাওয়া পর্ব সারতে। সবাই বলতে- মুনা, মুনিয়া আর আরিফ। চা খাওয়ার পরই শুরু হবে তাদের প্রাত্যহিক আলোচনা, যেটার জন্য তারা সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে! সারাদিন খারাপ কাটলেও এই সময়টায় প্রিয় মানুষগুলোকে সংস্পর্শে থেকে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যায় তাদের।
চা খেতে খেতে আরিফ বলল, ” উফ আজকের চা টা যা অসাধারণ হয়েছে না! কিভাবে পারো মুনা? আমাকে একদিন চা বানানো শিখিয়ে দিও তো। ”
মুনিয়া মাঝখান থেকে বল উঠল, “বাবা, আমার তো চা খেতে অন্যদিনের মতই লাগছে, কোন স্পেশাল কিছু তো বুঝতে পারছিনা! ”
“উহু। মোটেও না, ভালো করে খেয়াল করে দ্যাখ- আজকের চা তে অন্যরকম ফ্লেভার। তোর মা খুব মমতা নিয়ে বানিয়েছে তো, তাই! আমি একদিন বানিয়ে খাওয়াব, দেখিস টেস্ট করে। এরকম জীবনেও হবে না! ”
এদিকে মুনা হাসতে হাসতে শেষ। “হয়েছে তোমরা থাম…আমি জানি এটা তেমন কিছুই হয়নি। আমি যা করি সবই তোমাদের ভালো লাগে, মমতা নিয়ে দেখলে সাধারণ জিনিস ও অসাধারণ মনে হয়। খুব বেশি ভালোবাসো তো আমাকে, তাই! ”
মুনিয়া হুঁশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” তোমাদের এইসব কঠিন কঠিন কথা আমি কিচ্ছু বুঝিনা! ”
এভাবে হাসতে হাসতে একটা সন্ধ্যা কেটে গেলো।
এরপর তারা আলোচনা করলো সারাদিন কার কেমন কাটলো সেটা নিয়ে।
তারা পরস্পরকে সান্ত্বনা দিল, তাদের সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিল। সারাদিনের দুঃখ, frustration যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল ভালোবাসায়, হাসিতে, মমতায়। মুনার গোলাপি ব্যাগের কথা মনে পড়ল না, টিভিতে সিরিয়াল দেখার চেয়েও বহুগূণ বেশি আনন্দের সন্ধান পেলো সে। আরিফ অফিসের হিসেবের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলো, মানিব্যাগের কথাও মনে রইল না। মুনিয়ার মুখে হাসি ফুটল- তার বানানো কার্ড যা তার প্রাণের বন্ধু ফিরিয়ে দিয়েছিল…সেটা দেখে বাবা-মা এতই প্রশংসা করল যে সে তক্ষুনি তাদের জন্য কার্ড বানাবে বলে প্রমিজ করে ফেলল! আরিফ জানলো, অফিসের বসের কাছে তার চেষ্টার, তার যোগ্যতার মূল্য না থাকতে পারে- কিন্তু ঘরের এই মানুষগুলোর কাছে সে অমূল্য। মুনা বুঝতে পারলো- গণস্রোতে গা না ভাসানো সবসময় খুব খারাপ ব্যপার নয়! আর এদিকে বাবা-মা’র তুমুল উৎসাহপূর্ন কথা শুনে মুনিয়ার মনে হল- সামনের পরীক্ষায় সে আরো ভালো ফলাফল করতে পারবে!
তারপর তারা একে অন্যের জন্য আনা উপহার বের করল! মুনা পেল তার গোলাপি ব্যাগ, আরিফ তার হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগের চেয়েও ভালো একটা মানিব্যাগ পেল। মুনিয়া পেল খেলনা, চকলেট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা তারা প্রত্যেকে পেল সেটা হচ্ছে- একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, মমতা, care. একে অন্যের কথা চিন্তা করা, তাদেরকে priority দেওয়া যে কখনো বৃথা যেতে পারেনা, এবং ভালোবাসা যত দেওয়া হয় তার চেয়ে বহুগুণ ফেরত পাওয়া যায়- এই সত্য কথাগুলো তারা যেন নতুনভাবে অনুভব করল!
চা খাওয়া পর্ব শেষ হতেই তারা প্রতিদিনের মত কুরআন নিয়ে একটা ছোট্ট আলোচনা করল।
“আজ আমরা কি নিয়ে কথা বলব বাবা?” মুনিয়ার প্রশ্ন।
আরিফ বলল, ” আজকে আমরা কথা বলব সূরা ফুরকানের একটা আয়াত নিয়ে, কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের আজকের ঘটনাগুলো নিয়ে এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ”
“…এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” (২৫:৭৪)
“এখানে চোখের শীতলতা বলতে কি বুঝাচ্ছে? ” আবারও মুনিয়ার প্রশ্ন।
এইবার মুনা বলে উঠল,” এটা একটা উপহার, যা আজকে আমাদের পাওয়া উপহারগুলোর চেয়েও অনেক দামী, অনেক সুন্দর। সারাদিন বাইরে আমরা কত কষ্ট করি, কিন্তু বাড়িতে এসে শান্তি খুঁজে পাই! যদি বাড়িতে এসেও আমরা ঝগড়া করতাম, একে অন্যকে কষ্ট দিতাম, টেনশনের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিতাম, তাহলে কি ভালো হত, বল? দিন দিন অশান্তি আরো বাড়ত। এই জন্য আমরা আল্লাহর কাছে চাই, যেন তিনি আমাদের সঙ্গী, এবং আমাদের বাচ্চা কাচ্চা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষ থেকে আমাদের শান্তি, স্বস্তি দান করেন। বাইরের ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে দিন শেষে নীড়ে ফেরা পাখিদের মতই আমরা যেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় আর শান্তি খুঁজে পাই। বুঝেছিস?”
“একটু একটু ” মুনিয়াকে চিন্তিত দেখালো। তার ছোট্ট মাথায় অনেক কিছুই ঢুকল না, আবছা আবছা থেকে গেলো।
আরিফ বলল,” আমাকে বাসায় আসতে দেখলে তোর কেমন লাগে রে মুনিয়াপাখি? ”
“খুব ভালো লাগে বাবা ” মুনিয়ার সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর!
“আমারও তোকে দেখলে, তোর মা কে দেখলে এমন লাগে। অসাধারণ এক শান্তি! সারাদিন তাই ভাবি, কখন বাসায় আসব! আর এটাই আমার চোখের শীতলতা। “
“এবার বুঝেছি বাবা ” ছুটে গিয়ে বাবার কোলে মুখ লুকানো, এক হাতে মা’কে আঁকড়ে ধরা মুনিয়ার উত্তর
দিন শেষে নীড়ে ফেরা পাখিরা বুঝি এমন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই ফিরে আসে! ♥ !
লেখিকা - তাসনীম তারান্নুম ইসাবা
STA-5.160
সকাল ৬ টা বাজে।
প্রায় আট বছরের একটা ছোট্ট সংসারের কর্ত্রী মুনা। সে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। একটু পরই সবাইকে ডেকে তুলতে হবে, নাস্তা খাওয়াতে হবে, বাবুকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে এবং সবশেষে যেতে হবে টুকিটাকি কিছু বাজার করতে। হাতে সময় নেই একদম।
বাবুকে স্কুলে দিয়ে মুনা প্রায়ই স্কুলের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে অনেক সময় স্কুলের গার্জিয়ানরা একসাথে গল্প করেন। মুনা কখনো কখনো সেই গল্পে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রায়ই সে গল্পের বিষয়বস্তুর জন্য পিছু হটতে বাধ্য হয়! বেশিরভাগ সময় গল্পের বিষয়বস্তু হয় অন্যের পরচর্চা ( অধিকাংশ সময়ে নিজ নিজ স্বামীর কিংবা শ্বশুরবাড়ির) কিংবা শাড়ি-গহনার গল্প। মুনা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আজকের গল্পের বিষয়বস্তু- টিভিতে কোন একটা সিরিয়ালের কোন একটা চরিত্র।
কিছুক্ষন সেই সিরিয়ালের নায়িকার দুঃখ, নায়কের দুর্ভাগ্য নিয়ে আলোচনা আর ভিলেনের মুন্ডুপাত করার পর একজন ভদ্রতাবশত মুনাকে জিজ্ঞেস করল- “ভাবি এই ব্যাপারে আপনি কি বলেন? ”
মুনা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল- “আমি তো এইসব দেখিনা। ভালো লাগেনা। ”
“বলেন কি? ” সবাই অবাক। “তাহলে বাসায় সময় কাটান কিভাবে? ”
“এতদিন পড়াশোনা করতাম, তখন সেটা নিয়েই সময় কেটে যেত। এখন পরিবারকে সময় দেই, বাবুর সাথে খেলি। বাবুর আব্বুর সাথে গল্প করি। আর একা একা থাকলে বই পড়ি, নিজে নিজে পড়াশোনার চেষ্টা করি, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি, হাতের কাজ করি। সময় কখন কেটে যায় টেরই পাইনা।” মুনা স্মিত হাসার চেষ্টা করে।
সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সে একটা এলিয়েন। সবাইকে সালাম দিয়ে মুনা তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচল। পিছনে কিছু মানুষের ফিসফিসানি শুনতে পেলো সে। মুনা সেসব কথায় কান দিলো না, কিন্তু তার একটু মন খারাপ হল।
এরপর সে গেল বাজারে। খুব দামি একটা সুপারশপ- কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সবকিছু পাওয়া যায়। যা যা দরকার তা কেনার ফাঁকে ফাঁকে তার হুট করে চোখ পরল একটা খুব সুন্দর একটা ব্যাগ এর দিকে- কি কিউট দেখতে! হালকা গোলাপি রঙ, তার একটা শাড়ির সাথে খুব সুন্দর মানাবে। এমন একটা ব্যাগ সে অনেকদিন ধরে খুঁজছে। এগিয়ে গিয়ে দাম দেখলো মুনা- দেখে একটু দমে গেল। না , চাইলেই কিনতে পারে সে, এমন কিছু বেশি নয়। এমনিতে সে যথেষ্ট শৌখিন। বইপত্র কেনার পাশাপাশি এইসব টুকটাক শখের জিনিস কিনতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু তার হুট করে মনে পড়ল- বাবুর একটা নতুন খেলনার শখ অনেকদিনের। আর এদিকে বাবুর আব্বুর একটা মানিব্যাগ দরকার। এত্ত ভুলোমনা মানুষটা- আগেরটা ছিঁড়ে গেছে কিন্তু এখনো সেটা নিয়েই ঘুরছে! মুনার একটু রাগ হল।
সেই রাগমিশ্রিত মমতা নিয়ে মুনা খেলনা আর ছেলেদের মানিব্যাগের সেকশনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার মনেই রইল না ব্যাগটার কথা।
২.
আরিফ তার অফিসের ডেস্কে বসে আছে।
তার ইচ্ছে করছিল মাথার চুল ছিঁড়তে। সারাদিন ধরে কি একটা হিসেব সে কিছুতেই মিলাতে পারছে না। অফিসের বড়সাহেব কিছুক্ষন আগে একবার ঘুরে গেলেন। তার চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যে বলছেন- একটা সামান্য হিসাব ও মিলাতে পারেন না! আরিফের খুব লজ্জাও হচ্ছিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল এটা তার ভুল নয়- অন্য কোথাও কোন একটা গণ্ডগোল আছে। সে আল্লাহকে স্মরণ করলো।
এইদিকে জোহরের সালাতের সময় হয়ে গিয়েছে। সে উঠে পড়লো। পাশেই কলিগরা দেশের রাজনীতি অথবা ফুটবল এই ধরনের কোন একটা আলোচনা নিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডায় লিপ্ত। আরিফ কয়েকজনকে সালাতে যাওয়ার জন্য ডাকলো- প্রতিদিনই ডাকে। কেউ শোনে, কেউ শোনেনা। ফলস্বরূপ, তার কপালে জোটে “হুজুর” তকমা।
অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাস ধরতে হবে। হাতে এখনো কিছু সময় আছে। হুট করে আরিফের চোখে পড়ল- একটা দোকানের সাজিয়ে রাখা গোলাপি রঙের কি মিষ্টি দেখতে একটা পার্স! কাচের স্বচ্ছ দেয়ালের বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল- মুনা অনেকদিন ধরে এরকম একটা ব্যাগ খুঁজছে। কোনকিছু না ভেবেই ব্যাগটা কিনে ফেলল আরিফ । মাসের মাঝামাঝি সময়, একটু হিসেব করে চলা উচিত। সে পাত্তা দিলো না, যদি ব্যাগটা পরে আর না পাওয়া যায়! হাজার হলেও মেয়েটার অনেকদিনের শখ। সাথে কিছু ফুল আর বাবুর জন্য চকলেটও কিনে নিল। কেন জানি খুব খুশি খুশি লাগছিল তার।
বাস এসে পরেছে। আরিফ বাসে উঠে ভাড়া দেওয়ার সময় আবিষ্কার করলো- তার পকেটে মানিব্যাগটা নেই। সেখানে টাকা বেশি ছিলনা- একটু আগে জিনিসপত্র কিনে খরচ করে ফেলেছে! গুরুত্বপূর্ণ কাগজ বলতে আইডি কার্ডটা ছিল। সেটা পাওয়ার কোন একটা ব্যবস্থা করা যাবে, সে আল্লাহর উপর ভরসা রাখলো। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন ভালো উদ্দেশ্য আছে। বরং সে খুশি হল- একটা আগে কেনা ব্যাগ, চকলেট এগুলো এখনো তার হাতে আছে! আলহামদুলিল্লাহ।
৩.
ছোট্ট মেয়ে মুনিয়া, সে স্কুলে অনেক ছোট্ট ক্লাসে পড়ে । কিন্তু ক্লাস ছোট হলে কি হবে, তাদের পড়ার চাপ যথেষ্ট। আজকে তাদের ম্যাথ টেস্ট ছিল। অনেক পরিশ্রম করে এসেছিল সে, কিন্তু পরীক্ষা সে তুলনায় ভালো হয়নি! যদিও ক্লাসের মিস কিচ্ছু বলেননি, তবুও মুনিয়ার মন খারাপ হল।
মন খারাপ হওয়ার একটা কারণ- সে তার বন্ধু টুনটুনির জন্য একটা কার্ড বানিয়ে এনেছিল। রঙিন কাগজ, আর তার মধ্যে ক্রেয়ন দিয়ে ফুল পাতা আঁকা। অনেক শখকরে লুকিয়ে কার্ড টা বানিয়ে এনেছিল সে, প্রাণের বান্ধবী টুনটুনি কে সারপ্রাইজ দেবার জন্য। কিন্তু টুনটুনি বলেছে- কার্ডটা নাকি একটুও ভালো হয়নি। এর চেয়ে ঢের ভাল কার্ড নাকি সে নিজেই বানাতে পারে।
অভিমানে মুনিয়ার চোখ ভিজে উঠল। চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো সে। আজকের দিনটা এত্ত খারাপ কেন?
৪.
সন্ধ্যা ছয়টা।
বাসার সবাই বসেছে সন্ধ্যাকালীন চা খাওয়া পর্ব সারতে। সবাই বলতে- মুনা, মুনিয়া আর আরিফ। চা খাওয়ার পরই শুরু হবে তাদের প্রাত্যহিক আলোচনা, যেটার জন্য তারা সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে! সারাদিন খারাপ কাটলেও এই সময়টায় প্রিয় মানুষগুলোকে সংস্পর্শে থেকে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যায় তাদের।
চা খেতে খেতে আরিফ বলল, ” উফ আজকের চা টা যা অসাধারণ হয়েছে না! কিভাবে পারো মুনা? আমাকে একদিন চা বানানো শিখিয়ে দিও তো। ”
মুনিয়া মাঝখান থেকে বল উঠল, “বাবা, আমার তো চা খেতে অন্যদিনের মতই লাগছে, কোন স্পেশাল কিছু তো বুঝতে পারছিনা! ”
“উহু। মোটেও না, ভালো করে খেয়াল করে দ্যাখ- আজকের চা তে অন্যরকম ফ্লেভার। তোর মা খুব মমতা নিয়ে বানিয়েছে তো, তাই! আমি একদিন বানিয়ে খাওয়াব, দেখিস টেস্ট করে। এরকম জীবনেও হবে না! ”
এদিকে মুনা হাসতে হাসতে শেষ। “হয়েছে তোমরা থাম…আমি জানি এটা তেমন কিছুই হয়নি। আমি যা করি সবই তোমাদের ভালো লাগে, মমতা নিয়ে দেখলে সাধারণ জিনিস ও অসাধারণ মনে হয়। খুব বেশি ভালোবাসো তো আমাকে, তাই! ”
মুনিয়া হুঁশ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” তোমাদের এইসব কঠিন কঠিন কথা আমি কিচ্ছু বুঝিনা! ”
এভাবে হাসতে হাসতে একটা সন্ধ্যা কেটে গেলো।
এরপর তারা আলোচনা করলো সারাদিন কার কেমন কাটলো সেটা নিয়ে।
তারা পরস্পরকে সান্ত্বনা দিল, তাদের সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিল। সারাদিনের দুঃখ, frustration যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল ভালোবাসায়, হাসিতে, মমতায়। মুনার গোলাপি ব্যাগের কথা মনে পড়ল না, টিভিতে সিরিয়াল দেখার চেয়েও বহুগূণ বেশি আনন্দের সন্ধান পেলো সে। আরিফ অফিসের হিসেবের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলো, মানিব্যাগের কথাও মনে রইল না। মুনিয়ার মুখে হাসি ফুটল- তার বানানো কার্ড যা তার প্রাণের বন্ধু ফিরিয়ে দিয়েছিল…সেটা দেখে বাবা-মা এতই প্রশংসা করল যে সে তক্ষুনি তাদের জন্য কার্ড বানাবে বলে প্রমিজ করে ফেলল! আরিফ জানলো, অফিসের বসের কাছে তার চেষ্টার, তার যোগ্যতার মূল্য না থাকতে পারে- কিন্তু ঘরের এই মানুষগুলোর কাছে সে অমূল্য। মুনা বুঝতে পারলো- গণস্রোতে গা না ভাসানো সবসময় খুব খারাপ ব্যপার নয়! আর এদিকে বাবা-মা’র তুমুল উৎসাহপূর্ন কথা শুনে মুনিয়ার মনে হল- সামনের পরীক্ষায় সে আরো ভালো ফলাফল করতে পারবে!
তারপর তারা একে অন্যের জন্য আনা উপহার বের করল! মুনা পেল তার গোলাপি ব্যাগ, আরিফ তার হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগের চেয়েও ভালো একটা মানিব্যাগ পেল। মুনিয়া পেল খেলনা, চকলেট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা তারা প্রত্যেকে পেল সেটা হচ্ছে- একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, মমতা, care. একে অন্যের কথা চিন্তা করা, তাদেরকে priority দেওয়া যে কখনো বৃথা যেতে পারেনা, এবং ভালোবাসা যত দেওয়া হয় তার চেয়ে বহুগুণ ফেরত পাওয়া যায়- এই সত্য কথাগুলো তারা যেন নতুনভাবে অনুভব করল!
চা খাওয়া পর্ব শেষ হতেই তারা প্রতিদিনের মত কুরআন নিয়ে একটা ছোট্ট আলোচনা করল।
“আজ আমরা কি নিয়ে কথা বলব বাবা?” মুনিয়ার প্রশ্ন।
আরিফ বলল, ” আজকে আমরা কথা বলব সূরা ফুরকানের একটা আয়াত নিয়ে, কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের আজকের ঘটনাগুলো নিয়ে এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ”
“…এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” (২৫:৭৪)
“এখানে চোখের শীতলতা বলতে কি বুঝাচ্ছে? ” আবারও মুনিয়ার প্রশ্ন।
এইবার মুনা বলে উঠল,” এটা একটা উপহার, যা আজকে আমাদের পাওয়া উপহারগুলোর চেয়েও অনেক দামী, অনেক সুন্দর। সারাদিন বাইরে আমরা কত কষ্ট করি, কিন্তু বাড়িতে এসে শান্তি খুঁজে পাই! যদি বাড়িতে এসেও আমরা ঝগড়া করতাম, একে অন্যকে কষ্ট দিতাম, টেনশনের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিতাম, তাহলে কি ভালো হত, বল? দিন দিন অশান্তি আরো বাড়ত। এই জন্য আমরা আল্লাহর কাছে চাই, যেন তিনি আমাদের সঙ্গী, এবং আমাদের বাচ্চা কাচ্চা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষ থেকে আমাদের শান্তি, স্বস্তি দান করেন। বাইরের ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে দিন শেষে নীড়ে ফেরা পাখিদের মতই আমরা যেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় আর শান্তি খুঁজে পাই। বুঝেছিস?”
“একটু একটু ” মুনিয়াকে চিন্তিত দেখালো। তার ছোট্ট মাথায় অনেক কিছুই ঢুকল না, আবছা আবছা থেকে গেলো।
আরিফ বলল,” আমাকে বাসায় আসতে দেখলে তোর কেমন লাগে রে মুনিয়াপাখি? ”
“খুব ভালো লাগে বাবা ” মুনিয়ার সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর!
“আমারও তোকে দেখলে, তোর মা কে দেখলে এমন লাগে। অসাধারণ এক শান্তি! সারাদিন তাই ভাবি, কখন বাসায় আসব! আর এটাই আমার চোখের শীতলতা। “
“এবার বুঝেছি বাবা ” ছুটে গিয়ে বাবার কোলে মুখ লুকানো, এক হাতে মা’কে আঁকড়ে ধরা মুনিয়ার উত্তর
দিন শেষে নীড়ে ফেরা পাখিরা বুঝি এমন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই ফিরে আসে! ♥ !
লেখিকা - তাসনীম তারান্নুম ইসাবা
STA-5.160
© 2014 by Ask Islam Bangla.