প্রশ্ন ৭ --> তাক্বলীদ কি ? কোন একটি মাযহাব অনুসরণ কি করতেই হবে ?
উত্তর :
আরবী ভাষাবিদরা বলেন যে “তাকলীদ” শব্দটি আরবী মুলরুপ “কালাদা” থেকে এসেছে যা বুঝায়-গলার রশি যা গলার চতুর্পার্শ্বে বাধানো অবস্থায় লাগানো থাকে। এটা থেকেই রাস্তা সম্পর্কে তাকলীদ শব্দটি এসেছে –গলারফিতার মতই একজন অনুসরণকারী একটি ফতোয়ার ক্ষেত্রে সে একজন মুজতাহিদের সাথে লেগে থাকে।
পরিভাষাগত সংজ্ঞায়ন(Technical Defination) :
ইমাম আশ-শাওকানি র. এর মত তাকলীদ হল –কারো প্রমানহীন কথার অনুসরণ করা।
আমাদের নোটে রাখা গুরুত্ত্বপুর্ণ এই বিষয়গুলো যে ,এই বিষয়টি কিছু জিনিসকে সরিয়ে রাখে…রাসুল সা. এর কথা, ইজমার অনুসরণ, অনভিজ্ঞ লোকের ক্ষেত্রে কোন মুফতির ফতোয়া অনুসরন এবং বিশ্বস্থযোগ্য কোন সাক্ষীর প্রমানের ক্ষেত্রে বিচারকের বিবেচনা-যেহেতু তাদের কর্তৃত্ব বা প্রমানের বিশ্বস্থতা একবার স্থাপন হয়ে গেছে।রাসুল সা.এর কথা ও ইজমা এ দু’টিই নির্ভরযোগ্য তথ্যের বা প্রমানের উতস হিসেবে আসবে ঐসব লোকদের জন্য যারা এগুলো শনাক্ত করতে পারবে।একজন অনভিজ্ঞ লোকের ক্ষেত্রে কোন মুফতির মতামত(Statement) অনুসরণ ইজমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । কেননা একজন বিশ্বস্থ সাক্ষীর মতামত বিচারকের বিবেচনার নিয়মের মধ্যেই পড়ে-এটার বিশ্বস্থতা বা উতস কুরান-সুন্নাহ উভয় থেকেই পাওয়া যায়-আদেশ থেকে সাক্ষ্য নেওয়া, যেমন নেওয়া যায় ইজমা থেকে।
তাকলীদের বিষয় থেকে আরো যেসব বিষয়গুলো বাদ যাবে-হাদীস ব্যাখ্যাকারীদের ব্যাখ্যাসমুহ ; যেহেতু তাদের অবস্থান ইতোমধ্যেই প্রামাণীকরণ ও বৈধতার পক্রিয়াধীন রয়েছে।অধিকন্তু,এগুলো শুধুমাত্র বর্ণনাকারীদের মতামতই নয়,বরং যার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কেও ।
আরো ভালো সংজ্ঞা পাওয়া যায় ইবনে হুমাম(মৃত্যু-৮৬১ হিজরী) এর “তাহরীর” এ :
“তাকলীদ হল এমন কারো মতামতের অনুসরণ করা যে প্রমানহীন-যাকে বিশ্বস্থ উতস হিসেবে শনাক্ত করা হয়নি(অর্থাস প্রমানহীন থাকার কারণে তার মতামত বিশ্বস্থ নয়)”।
আল-কাফফাল(মৃত্যু-৩৬৫ হিজরী)পরামর্শ দেন এই বিষয়ে –
“কোন মতামত এমন কারো কাছ থেকে নেওয়া যখন জানা যায়না যে সে কোথা থেকে এটা পেয়েছে ”
শাইখ আবু হামিদ আল-আশফারাইনী(মৃত্যু-৪০৪ হিজরী)ও উস্তাদ আবু মানসুর আব্দুল কাহির আল-বাগদাদী(মৃত্যু-৪২৯ হিজরী),তারা দুজনেই বর্ণনা করেন-
“এমন কারো কাছ থেকে কোন লিগাল মতামত গ্রহন করা যার বিশ্বস্থাতা প্রতিষ্ঠিত নয়-সাক্ষ্যপ্রমানহীন ব্যক্তি”
কোন একটি মাযহাব মানার ক্ষেত্রে নিয়ম তাকলীদ বিষয়ে তিনটি মতামত আছে :
প্রথম মত : মাযহাবের অনুসরণ বাধ্যতামুলক
প্রথম মতানুসারে তাকলীদ করা সবার জন্য বাধ্যতামুলক-সে অনভিজ্ঞ বা পারদর্শী লোক হোক না কেন ।এটা আধুনিক স্কলার বা আলেমদেরকে যে কোন ধরণের ইজতিহাদ করতে নিষেধ করে ।বরং ইজতিহাদ করতে তারা তত্ত্বগতভাবে নিষেধ বলে বিবেচনা করে ও বাস্তবিক দ্রৃষ্টিকোন থেকে অপ্রচলিত বা সেকেলে মনে করে-মনে করে ইজতিহাদের দরজা বা সুযোগ তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দীতে বা তার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে ।
এই মতামতটি অপরিহার্যভাবেই চার মাযহাবের কোন একটি মাযহাবের তাকলীদ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ধর্মীগত বাধ্যতামুলক মনে করে । যারা এই মতটি গ্রহন করেছে তারা তাদের অনুসরণীয় মাযহাবের বাহিরে আধুনিক স্কলারদের মতামতকে অনুমতি দেয়না । প্রচলিত এই চার মাযহাবের অনুসরণ থেকে বের হয়ে অন্য কোন মাযহাব বা মতামত অনুসরণ করা তাদের নিকট কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়(যদিও সেগুলো কোন সাহাবা বা তাবিয়ী থেকে আসুক না কেন )।
যারা এই দৃষ্টিকোন ধারণ করে তারা যদি প্রচলিত মতামত ও লোককথা আরেকটির উপর অগ্রাহ্য করে বা অধিক পছন্দনীয় মনে করে তবে তারা তাদের স্বাধীন ইজতিহাদী গবেষণা প্রত্যাখ্যানে আরো শক্তিশালী হয়-যদিও কোন বিষয়ে আংশিক ইজতিহাদ হোকনা কেন ।তারা এই ইজতিহাদকে প্রত্যাখ্যান করে কোন পরিরবর্তনীয় পরিস্থিতির বিবেচনা ছাড়াই-যেগুলো মানবজীবন তৈরি করে,চিন্তা-মতামত ও আদর্শে যা মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এগুলো তারা করে একটি বিশ্বাস থেকেই আর তা হল ইজতিহাদের দরজা প্রতিরোধ করতে হবে।
পরবর্তী কিছু আলেম চার মাযহাবের কোন একটি বাধ্যতামুলক অনুসরনের ব্যাপারে কথা বলেন। শেইখ সাওবী আল-মালিকী(Sawy মৃত্যু-১২৪১ হি),যিনি –“হাশিয়া”(-ব্যাখ্যা)লিখেন ইমাম আল-দারদির ফিকহের(Jurisprudence)বিষয়ে বই “আশ-শরহ আস-সাগীর” এর। এবং আরেকটি ব্যাখ্যা লিখেন তাফসির আল-জালালাইন এর উপর । তিনি বলেন :
“চার মাযহাব ছাড়া আর কোন মাযহাবের ক্ষেত্রে তাকলীদ করার অনুমতি নেই,যদিও সেটা কোন সাহাবার মতামত,ছহীহ হাদিস অথবা কোরানের কোন আয়াতের সাথে মিলে যায়-কেননা যে এই চার মাযহাবের কোন একটির বাহিরে সে পথভ্রষ্ট এবং অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করতেছে। সম্ভবত এটা তাকে ঈমানহীনতার দিকে নিয়ে যাবে,আপাত দৃষ্টিতে কুরান-সুন্নাহ থেকে নেওয়া হলেও এটার ভিত্তি বিশ্বাসহীনতা-ঈমানহীন”
এই শাইখের কট্ট্ররতা লক্ষ করুন যে ইমাম শাওকানী র. এর সমসাময়িকই ছিল –কিন্তু তাদের গভীর চিন্তার মধ্যে কত বিস্তর পার্থক্য ছিল । তিনি চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ করা নিষেধ করেন যদিও কোন মতামত বা ফতোয়া কোন সাহাবার রা.এর বক্তব্যের সাথে মিলে যায়,তার চেয়েও নিকৃষ্ট কথা তিনি বলেছেন তা হল-যদিও সেটা রাসুল সা.এর কোন ছহীহ হাদীসের সাথে মিলে যায়,এটার চেয়েও আরো কত নিকৃষ্ট কথা তিনি বলেছেন আর তা হল-যদিও এটা কোরানের আয়াতের সাথে মিলে যায় !(তারপরো সাহাবার কথা,ছহীহ হাদীস বা কোরানের আয়াত বাদ দিয়ে(মিলে গেলেও) মাযহাবের তাকলীদ করা বাধ্যতামুলক !!)
আরেকটি অত্যুক্তিমুলক অতিরঞ্জন দেখুন –চার মাযহাবের(কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়েও) বাহিরে কোন লোককে “পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্ট করতেছে” বলে বিবেচনা করছে এবং এটা কোন ঈমানহীনতার দিকে পরিচালিত করবে !! এই সব কিছুই হঠকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা এবং অনুসন্ধানী স্কলার বা আলেমের সর্বসম্মত মতের বিরোধিতা। তাকলিদ করা বাধ্যতামুলক-এই ধরণের মত পরবর্তী ধর্মীয় গোষ্টি মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে নেওয়া হয়ছিল অনেক পরের শতাব্দীতে ।সালাফ(প্রথম যুগ-বংশধর) বা মাদ্রাসার পন্ডিতরা এটা শিক্ষা দিয়েছিল তাদের অধস্থনদের ও এইসব ছাত্রদের নিকটই এটা সঞ্চারণ করতে শুরু করেছিল-
“যে ব্যক্তি কোন আলেমের তাকলীদ করে সে আল্লাহর নিরাপত্তা পায়”
আমি আল-আযহারে মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে এই সব শিক্ষার কথা মনে করি যখন তাওহীদের উপর ক্লাস নিতেন ।আমার বাধ্যতামুলক পড়ার মধ্যে কারানীর জাওহারাহ ও তার আল বাজুরীর ব্যাখ্যা-যেখানে লেখক বলেন-
“ইমাম মালেক এবং অন্যান্ন আলেম যেমন আবু কাসেম যারা উম্মতকে সৎ পথ দেখিয়েছেন-তাকলীদ করা শিক্ষিত লোকদের জন্য ফরজ-কেননা একজন যে কোন ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ উপলব্দির দিক থেকে কোন একটির দিকে সম্পৃক্ত থাকে”
আল-কাসেম এখানে বিশিষ্ট সুফি আল-জুনায়েদ ইবনে আহমদ র.(মৃত-২৯৭ হি) এর কথা উল্লেখ করেন । এটা ইংগিত করে যে চার মাযহাবের ইমামসমুহের মধ্য থেকে কোন একজন ইমামকে অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর বাধ্যতামুলক।
বিশেষত ইমাম মালেক র.কে উল্লেখ করা যেতে পারে কেননা লেখক মালিকী মাযহাবের । তিনি বলেন- একজন ইমামকে অনুসরণ করতে হবে সেইভাবে যেভাবে সুফি ইমামরা(আত্মার) উন্নয়নের (Tarbiyah-self development) ধাপগুলো অনুসরণ করে। যেমন জুনায়েদের উত্তরাধিকার ছিলেন তার আলেমদের সাথে –তার তরিকতের(method)পুর্ণতা, অটুট নির্দেশনা,আর তার চরমপন্থা ও বিদআত থেকে দুরত্ত্বের কারণে ।
কিছু কিছু স্কলার বলেন আকীদার ক্ষেত্রে কোন একজন ভালো ইমামের নির্দেশ অনুসরণ জরুরী।এর মধ্যে রয়েছে-আবুল হাসান আল-আশয়ারী(মৃ-৩৩৪ হি), অথবা আবুল মানসুর আল-মাতুরিদী।
তবে পুর্ব(মাগরিব)দেশসমুহের(লিবিয়া,তিউনিশিয়া,আলজেরিয়া,মরক্কু ও মৌরতানিয়া)জ্ঞানীদের ভাতৃবৃন্দ ও জায়তুনা,কাইরাওনিয়া,ও অন্যান্ন প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটদের মাঝে প্রচলিত একটা নিয়ম হল আশয়ারী মাযহাব অনুসরণ করতে হবে আকীদার ক্ষেত্রে,ফিকহের ক্ষেত্রে মালিকী মাযহাব,আর সুফির ক্ষেত্রে জুনায়েদ রা.এর পথনির্দেশনা ।
এই মত এর অবিচ্ছেদ্য ও সম্ভাব্য খুটীনাটি বিষয়গুলো এক সাথে বললে যে বিষয়গুলো অন্তুর্ভুক হবে…
তাকলীদের ব্যাপারে এই ধরণের দৃষ্টিভংগির বিষয়ে অনেক আলেম বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন-তাদের মধ্যে রয়েছে—ইবনে আব্দুল বার্, ইবেন হাজম,ইবনে তায়মিয়াহ,ইবনুল কাউয়ুম,আস-সানানী ,আশ-শাওকানী ও আল-দেহলভী সহ আরো অনেকে।
দ্বিতীয় মত : তাকলীদের নিষিদ্ধতা ও ইজতিহাদের আবশ্যকতা
দ্বিতীয় মতটি প্রথমটির ঠিক বিপরীত-তাকলীদের বিরোধিতা ও সবার জন্য ইজতিহাদের বাধ্যবাধকতা ।যারা এই মতামতটি ধারণ্ করেন তারা বলেন যে, কুরান-সুন্নাহ থেকে সরাসরি আইনগত নিয়ম-বিধান(Legal Ruling) নেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামুলক। তারা চার মাযহাবের অনুসরণ করা তীব্রভাবে বিরোধিতা করে,এমনকি তারা এই সব প্রপাগান্ডা-প্রচারণাকে প্রচন্ডভাবে সমালোচনা করে। সম্ভবত তাদের কিছু লোকের তাকলীদের সমালোচনা বা তাকলীদের উপর আঘাত অতিরিক্ত হয়ে যায় কেননা তারা নিজেরাই মাযহাবীদের প্রবল আঘাত করে আর তাদের কিছু লোক মাযহাব প্রতিষ্ঠাকারীদেরকে মিথ্যা কলংকও আরোপ করে বা অপবাদ দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে, এই দৃষ্টিভংগিদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রস্তাবক হল,যাকে আমরা বিখ্যাত যাহিরী ফিকহবিদ হিসেবে জানি, সেই –আবু মুহাম্মদ ইবনে হাজম ।তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন তার মধ্যে-Principles of Jurisprudence-উসুল আল-ফিকহ এর ভিত্তি নিয়ে “আল-আহকাম ফি উসুল আল-ফিকহ”, তুলনামুলক ফিকহ নিয়ে “আল-মুহাল্লা” এবং ধর্মের ইতিহাস,বিভিন্ন উপদল ও অন্যান্ন বিষয় নিয়ে “আল-ফাসল ফিল মিলাল ওয়ান নিহাল” অন্যতম।
এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে সেরা স্কলার-ইমাম আশ-শাওকানী,যিন এই মতামতের উপলব্ধি বিস্তৃতি করতে বই লিখে সহায়তা করে-তার বই সমুহের মধ্যে-“ইরশাদ আল ফুহুল”, “আস সাইল আল-জারার”, এবং তার চিঠি “আল-কাওল আল মুফিদ ফিল ইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদ” অন্যতম।তিনি দৃঢ়ভাবেই তাকলীদকে অস্বীকার করেছেন যদিও তা ইবনে হাজমের চাইতে কিছুটা কম দৃঢ় ছিল।
আমাদের সময় একটা গ্রুপ আছে যারা হাদীস বিষয়ে সেরা ,নাসিরুদ্দিন আলবানীসহ তার অনুসারীরা পুরোভাগ এই দলে আছে।যারা এই মতের বিরোধী তারা এদেকে নাম দিয়েছেন “লা মাযহাবী” বা “যাদের কোন মাযহাব নেই”-কারণ তারা কোন মাযহাব গ্রহন করা প্রত্যাখ্যান করে ; তা কোন আলেমের জন্যই হোক বা অনভিজ্ঞ ব্যক্তির জন্যই হোক না কেন । এই মাযহাবহীনদের বিরোধিতাকারীরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক আরটিকেল লিখার মাধ্যমে।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-তুরকীর শেইখ মুহাম্মাদ জাহির আল-কাউসার এর “আল লা মাযহাবিয়া কেনতারা ইল্লা আল-লা দ্বীনিয়া ” এবং হামায়ী আলেমরা যেমন-শেইখ মুহাম্মাদ আল-হামিদ, ড. মুহাম্মাদ সাইদ রামাদান আল-বুতির বই “আল লা-মাযহাবিয়া আখতার বিদাহ তাহাদ্দাত আশ-শারিয়াহ আল -ইসলামিয়াহ” অন্যতম।
আবারো আমরা এই চরমপন্থার অবিচ্চছেদ্য ও খুটিনাটি বিষয়গুলো সারসংক্ষেপ নিম্নরুপ দেখাবো
ইমাম আশ-শাওকানী ও তাকলীদ
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী আশ-শাওকানী র. (মৃত-১২৫০ হি) ছিলেন তের শতক হিজরীর একজন উচু মাপের পুর্ণজাগরণ ও ইজতিহাদের নেতা ,যা তার ইজতিহাদের বই থেকে সুস্পষ্ট ।উদাহরণ দেওয়া যায়-বই আছার এর ব্যাখ্যা (যা যাইদী বা হাদুভী এর ফিকহের মুল বই হিসেবে বিবেচিত),তিনি সেখানে স্বাধীন ইজতিহাদের পথে আনন্দে ভেসে বেড়ান ;তিনি কুরান-সুন্নাহ ব্যবহার করে নিজেই আইনগত-ধর্মীয় মতামত দেন যা সেই সময়ের চার বা আট মাযহাবের বাহিরে ছিল।তার “নাইলুল আওতার” হল আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ যেখানে তিনি ইবনে তায়মিয়া র. এর “মুন্তাখাব আল-আখবার আহাদিস সাইয়্যিদ আল আখবার” এর ব্যাখ্যা করেন।এই বইটি সুন্নী ও সুন্নী নয় এমন মাযহাবীদের কাছেও আধুনিক ফিকহের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্ত্বপুর্ণ সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে আজ অবধি পর্যন্ত। আরেকটি উদাহরণ হল তার “আল-দারারি আল-মুওয়াইয়াহ”(যা আল-দুরার আল বাইইয়াহ এর ব্যাখ্যা) যেখানে তিনি স্বাতন্ত্র ফিকহের সারাংশ করেন।
প্রকৃত পক্ষে ,ইমাম আশ-শাওকানী র. তীব্রভাবে তাকলীদের বিরোধীতা করে ও ইজতিহাদের কথা বলেন তার একাধিক বই এ।
আশ-শাওকানী তাকলীদ এর অনুসারীদের যুক্তির ভিত্তির কিছু বিকল্প ব্যাখ্যার প্রস্তাব দেন (যেমন তারা তাকলীদের ভিত্তির যুক্তি-“যদি তোমরা না জান তবে যাদের স্মরণে আছে তাদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও”-আল-কোরান সুরা নাহল-৪৩ এবং রাসুল সা. এর বাণী-“তারা যদি না জানে তবে কি তারা জিজ্ঞেস করেনা ? বিভ্রান্তির চিকিতসা হল অনুসন্ধান করা বা জানতে চানতে চাওয়া”)।ইমাম আশ-শাওকানী পরিষ্কার করে বলেন যে এই সব প্রত্যেকটা বিষয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের তাকলীদ চাপায় না(অর্থাৎ এইসব দলীল দ্বারা এটা বুঝায় না যে প্রত্যেকটা বিষয়েই কোন আলেমের তাকলীদ করতে হবে ) বরং এটা বুঝাচ্ছে যে যাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ আছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেমনটা রাসুল সা. ও তার সাহাবা রা. এর সময়কার রীতি ছিল।
আশ-শাওকানী ইমাম ইবনুল কাইয়ুম র. এর লেখা থেকে উপকৃত হন-যা তাকলীদকে প্রত্যাখ্যান করেছিল-এবং আরো ইমাম ইবনে আব্দুল বারর ,ইবনে হাজম ,এদের লেখা ও তার পুর্ব্বর্তীদের লেখা থেকেও উপকৃত হন। “ইজতিহাদে দরজা বন্ধ” এই বিষয়টির বিরোধিতাও করেন তিনি-তিনি এটাকে নিন্দনীয় বিদয়াত মনে করেন।তিন বলেন-আল্লাহর অনুগ্রহ অসীম,এবং এটা একটা নির্দিষ্ট যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যাবেনা, অথবা কোন একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টির দ্বারা একচেটিয়া অধিকারত্ত্বে নিয়ে নেওয়া যাবেনা।বরং এটা ঐসব লোকদের জন্য খোলা আল্লাহ যাদের এর যোগ্যতা দান করেছেন।
আশ-শাওকানী ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন ও প্রকৃত ও স্বাধীন ইজতিহাদ গবেষনার আহবান জানান। তিনি কোন পরিচিত মাযহাবের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না তা ফিকহের বুনিয়াদি মুলনীতিমালার ই হোক বা প্রকৃত ফিকহ ই হোক-বরং তিনি সর্বপ্রথম জাইদী থেকে বের হয়ে নতুন করে শুরু করেন । এমন কি তিনি নিজেই বুনিয়াদি মুলনীতিমালা উন্নয়ন করেন,যা তিনি তার গ্রন্থ “আল-ইরশাদ আল ফুহুল ইলা তাহকীক আল হাক্ক মিনাল ইল্ম আল-উসুল” তে ব্যাখ্যা করেন।
অবশ্য তিনি স্বাধীন আইনগত যুক্তি ও রায় এর ব্যবহারের বিরোধিতা করেন ফিকহের ক্ষেত্রে এবং পুর্ণভাবে রায় মাযহাবের বিরোধিতা করেন তার যুগে । তার পরিবর্তে তিনি সম্পুর্ণুরুপে ওহীর উপর গুরুত্ত্বারোপ করেন-তিনি বলেন যে ধর্ম ইমামদের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি বরং ধর্মের নির্দিষ্টতামুলক(Seal)বর্ণনা ,মুহাম্মাদ সা. এর মাধ্যমে এসেছে।তিনি বিশ্বাস করেন যে যে সব অনভিজ্ঞ লোকেরা ইজতিহাদ করার ব্যাপারে বৈশিষ্টসম্পন্ন নয় তারা কোন আলেমকে খুজে তার কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে কুরান-সুন্নাহর উপর তাদের অবস্থান করার চেষ্টা করবেন এবং ঐসব আলেমদের মতামতের উপর ভিত্তি করবেনা।
আমি শাওকানীর সাথে কিছু বিষয়ে একমত আর কিছু বিষয়ে ভিন্নতা অবলম্বন করি।আমি তার সাথে যেই সব বিষয়ে একমত সেগুলো হল…
যাইহোক,আমি সাধারণ মানুষের উপর তাকলীদের নিষিদ্ধতা প্রচন্ডভাবে বিরোধিতা করি এবং শধুমাত্র কোন একটি মাযহাবের অনুসরণে তার নিষিদ্ধতাও।আমি এমন কিছু দেখিনা যা মানুষকে কোন একজন ইমাম অনুসরণ করা ও কোন মাযহাবের সাথে থাকা বিরত রাখে-সেটা ইমাম আবু হানিফা,মালিক,শাফিয়ী আহমাদ,যাইদ,আল-হাদি ,জাফার ও অন্য যে কোন মাযহাবই হোকনা কেন।শরীয়ার ভিত্তিতে এটা অনুমদিত,কিন্তু বাধ্যতামুলক নয়। কিন্তু একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির জন্য ভালো অবস্থান হল তার কোন মাযহাব না রাখা। বরং তার মাযহাব হবে ঐসব স্কলার যাদের থেকে কোন বিষয় জিজ্ঞেস করে জেনে নিবে।যেহেতু সে তার মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাবে যাওয়ার অনুমতি আছে ,তাই সে যে কোন বিষয়ে যে কোন আলেমের কাছে সে জানতে চাইতে পারে যা তার কাছে গুরুত্ত্বপুর্ণ মনে হয় ।সে যদি ইচ্ছা করে এক মাযহাব ছেড়ে আরেক মাযহাবে যাবে,তবে যেতে পারে , যদি সে বিশ্বাস করে যে ঐ মাযহাবের দলীল-প্রমান অধিকতর শক্তিশালী।
আমি ইমাম আশ-শাওকানী সাথে আরো ভিন্নমত পোষণ করি ফিকহে শাওকানীর স্বাধীন লিগাল যুক্তির ব্যবহার ও রায় এর বিরোধিতার ক্ষেত্রে,কেননা সেটা শরীয়ার বিরোধী হয় যায়।সত্য হল রায়(যুক্তি) ছাড়া কোন ফিকহ নেই।নিন্দনীয় রায় হল যেটা স্পষ্ট কিতাবের(কুরান-সুন্নাহ)বিরুদ্ধে যায়।অতএব রায় বা যুক্তি আসবে সেই স্থানে যেখানে কিতাবের ভিত্তি নেই আর রায়কে তখন ব্যবহার করা হবে প্রতিষ্টিত মুলনীতিমালা ও শরীয়র উচ্চত্তর উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে কুরান-সুন্নাহ ভালো করে বুঝার জন্য, এটা অবপরিহার্য।ঐ সমস্ত ক্ষেত্রসমহে রায় অবশ্যই থাকবে যেখানে সুনির্দিষ্ট আইনগত নমনীয়তার(দুর্বলতার) কারণে সেগুলোর প্রতি ভালো করে লক্ষ করা হয়নি বা যেই সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিতাবের অভাব রয়েছে যা স্পষ্টভাবেই অন্যকিছু নিতে হয়।
এই সব ক্ষেত্রগুলো :
এই সব গুলো ক্ষেত্রই রায় এর ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করে।একজন ফিকহবীদ কি এগুলো ব্যবহারের উপরে(বাইরে) থাকতে পারে? এই কারণেই ,পছন্দনীয় ব্যক্তিসমুহ যেমন ওমর,ওসমান,আলী,ইবনে মাসউদ,যাইদ,ইবনে আব্বাস ও অন্যান্ন লোকদের ফিকহ,এটা(রায়)থেকে কি তারা মুক্ত ?
রায় ছাড়াও কি তথাপি কিতাবগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব ? বনু কুরায়যায় যাওয়ার পথে আসরের সালাত আদায় করার সময় রাসুল সা.এর সাহাবারা কি রায়(যুক্তি) ব্যবহার করেনি ? ইবনে তায়মিয়ার র.যেমন প্রস্তাব দিয়েছে-যারা সালাত আদায় করেছিল তারাই অধিক সঠিক ছিল যারা সালাত আদায়ে দেড়ি করেছিল যতক্ষণ না তারা তাদের গন্তব্যে পৌছে যায় কিন্তু সেটা ছিল আসরের সালাত অতিক্রম সময়।
এই উদাহরণগুলো কি কুরান ও সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে রায়(যুক্তি)এর ব্যবহার শরীয়ার উচ্চতর লক্ষ্য নয় ?
দুর্ভিক্ষের সময় চুরি করার শাস্তি মুলতবি কি ওমর রা.এর রায়(যুক্তির) উদাহরণ নয় ? রক্তপন এর দায়িত্ত্ব গোত্র থেকে রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত করার তার সিদ্ধান্ত কি রায় এর নমুনা নয়? ইরাকের নির্দিষ্ট জয় করা অঞ্চল মুসলিমদের বন্টন করে দেওয়ার বিপক্ষে তার সিদ্ধান্ত কি রায় এর নমুনা নয় ? আহলে কিতাবধারী নারীদের বিবাহের নিষেধ ,মুসলিম নারীদের উপর প্রভাবের ভয় থেকে,কি তার রায় এর উদাহরণ নয় ? আসল ভাই ও সৎ ভাই(মা এর দিক থেকে) এর উত্তরাধিকার আইন একত্র করার সিদ্ধান্ত-যদিও অন্য নিয়ম আছে,কি রায় এর নমুনা নয় ? স্বামী যখন মৃত্যু আসন্ন রোগে ভুগছে এই অবস্থায় তালাক উচ্চারণ করার শর্ত নেই-এটা কি উসমান রা.এর যুক্তি বা রায় এর অবস্থান ছিলনা ? আবু বকর ও অন্যান্ন সাহাবা রা.কর্তৃক বর্ণিত আছে –
আমি আমার রায় বা যুক্তি দিয়ে লিগাল আদেশ জারি করি।আর এই কারণে এটা যদি সঠিক হয় তবে তা আল্লাহ থেকে আর যদি ভুল হয় তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কি ভুল থেকে মুক্ত নয় ?
যখন মুয়াজ রা.কে তিনি ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন তখন কি মহানবী সা. মুয়াজ রা.এর উত্তরগুলো গ্রহন করেননি ? যখন তিনি বলেছিলেন-তুমি কি দিয়ে ন্যায় বিচার করবে ? মুয়াজ রা.উত্তর দিয়েছিল যে তিনি আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফয়সালা করবেন,তারপর রাসুল সা.এর সুন্নাহ দিয়ে।আর যদি কিতাব বা সুন্নাহতে উত্তর না পাওয়া যায় তবে আমি আমার যুক্তির মাধ্যমে ইজতিহাদ করব।
রাসুল সা.এর সাহাবারা কি তাদের যুক্তি ও উপলব্ধির ভিন্নতার কারণে কিছু নিয়মের মাঝে মতভেদ করেনি ?
তৃত্বীয় মত : ঐ লোকের তাকলীদ করা আবশ্যক যে ইজতিহাদের করার লেভেল অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম মতের মত এটি সমর্থকদের উপর তাকলীদকে চাপিয়ে দেয়না বা দিত্বীয় মতের মত নিষেধও করেনা। বরং এই মত কিছু মানুষের জন্য তাকলীদ অনুসরণ করার অনুমতি দেয় আর কিছু লোকের জন্য নিষেধ করে।ইমাম হাসান আল-বাসরি তার “20 Principles of Understanding”( উপলব্ধির ২০টি মুলনীতি)র একটিতে আলোচনা করেন।
“প্রত্যেকে মুসলিম যারা (Legal Deduction)আইনগত অবরোহ(Reasoning from the general to the particular)ও ফিকহ এর যুক্তি বুঝার স্তরে পৌছেনি তাদেরকে ইসলামী ফিকহের ইমামদের কাজসমুহকে অনুসরণ করার জন্য উতসাহিত হয়।একজন ইমামকে অনুসরণ করার সময় একজন লোককে অবশ্যই ইমামের যুক্তি বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।যখন একজন ইমামের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে,একজনের উচিত উপযুক্ত যুক্তিসমৃদ্ধ যে কোন ইমামের সঠিক পথ গ্রহন করা। এর সাথে,একজন মুসলিমকে আইনগত অবরোহ পদ্ধতি ও ফিকহ উপলব্ধির লেভেল অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টাসমুহ চালিয়ে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।”
এভাবে তিনি তাকলীদ বা একটি মাযহাবকে অনুসরণ বাধ্যতামুলক করেননি,আর তিনি নিষেধও করেননি,তিনি এর অনুমতি দিয়েছেন,কিন্তু সবার জন্য নয়।এটা আইনগতভাবে অনুমদিত শুধুমাত্র ঐ সব লোকের জন্য যারা-““প্রত্যেকে মুসলিম যারা (Legal Deduction)আইনগত অবরোহ(Reasoning from the general to the particular) এর যুক্তি বুঝার স্তরে পৌছেনি”।তার মানে এটা অনভিজ্ঞ লোকদের জন্য যারা কুরান-সুন্নাহ থেকে নিয়ম(Rulings)বা্র করার ক্ষেত্রে বৈশিষ্টসম্পন্ন নয় বা ইজমা ,কিয়াস,ও অন্যান্ন পদ্ধতিসমুহ যেগুলো এই সব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যেমন ইসতিসলাহ,উরফ,ইসতিসহাব,ও আমাদের সম্মুখের শরীয়ার অন্যান্ন বিষয়াদি জানেনা,(তাদের জন্য মাযহাব বা তাকলীদ(অনুমদিত বা)।
অনুসরণ বনাম অন্ধ অনুকরণ
Following vs.Blindly Imitating
উস্তাদ আল-বান্না তার প্রাজ্ঞতার মুলনীতিতে ইত্তিবা(অনুসরণ-দলীলসহ)কে তাকলীদের(অন্ধভাবে অনুকরন) উপর প্রাধান্য দেন।তিনি বলেন-“মুসলিমদেরকে ইসলামী ফিকহের কোন এক ইমামকে অনুসরণ(অনুকরণ নয়) করতে হয়”।আল কুরআনেও ইত্তিবা(আলে-ইমরান-৩১)(দলীলসহ অনুসরণ)শব্দটি ব্যবহার করে এই প্রসঙ্গে যা এটাকে প্রশংসাযোগ্য ও আইনগত গ্রহনযোগ্য করে তুলে।
ইব্রাহীম আ.এর বর্ণনার মাঝে এটা দেখা যায়-
“হে আমার পিতা,আমার নিকট জ্ঞান এসেছে যা আপনার নিকট আসেনি ,সুতরাং আপনি আমার অনুসরণ করুন ,আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো”(সুরা মারইয়াম-৪৯)
এই আয়াত যে কাউকে এমন একজন লোকের অনুসরণ করার আহবান জানায় যিনি এমন ক্ষেত্রে জ্ঞানী যা সে জানেনা।
আমরা মুসা আ. ও আল্লাহর বিখ্যাত সত বান্দার(খিযির আ.)ঘটনাতেও পাই-
“অতঃপর তারা সাক্ষাত পেল আমার বান্দাদের মধ্য হত একজন যাকে আমি অনুগ্রহ করেছি ও যাকে শিক্ষা দিয়েছি এক বিশেষ জ্ঞান।মুসা আ. বললেন-আমি কি আপনাকে অনুসরণ করতে পারি ? যাতে আপনাকে যেই সৎ পথ শিখানো হয়েছে আমি শিখতে পারি।” (সুরা কাহাফ-৬৫-৬৬)
মুসা আ. খিযির আ. এর অনুসরন করার(ইত্তাবিয়া) অনুমতি প্রার্থনা করলেন যাতে তিনি প্রশংসিত আল্লাহ যেই জ্ঞান তাকে দান করেছেন তা শিখতে পারেন। এটা দেখাচ্ছে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রসমুহে জ্ঞানী লোককে অনুসরণ করা নিন্দনীয় নয়।
ইমাম আবু উমার ইবনে আব্দুল বারর বলেন-জ্ঞানের উদ্দেশ্য হল বদান্যতা-যেইরকম সত্যিকার ভাবে এটা জানা সেইভাবেই এটাকে আত্মস্থ করা।কারণ যখন কোনকিছু কারো নিকট পরিষ্কার করা হয় ,তখন সে এটা জেনে যায়।পন্ডিতরা বলেন যে-যে ব্যক্তি তাকলীদ করে তার কোন জ্ঞান নেই,আর এই বিষয়ে সব পন্ডিত একমত।আবু আব্দুল্লাহ বিন খুওয়াইজ মিন্দাদ আল-বাসরি আল-মালিকী বলেন –
“তাকলীদ অর্থ এমন বর্ণনার দিকে ফিরে যাওয়া যেটির উল্লেখযোগ্য দলীল-প্রমান নেই।ইত্তিবা যা এমন বর্ণনার দিকে নির্দেশ করে যা বৈধ সত্যতাসহকারে গ্রথিত। ইত্তিবাই ধর্মে অনুমদিত,তাকলীদ নয়।“
ড: ইউসুফ আল কারজাভীর প্রবন্ধ হতে অনুবাদ করেছেন এনামুল হক হোমাইদ ।
STA-2.2
আরবী ভাষাবিদরা বলেন যে “তাকলীদ” শব্দটি আরবী মুলরুপ “কালাদা” থেকে এসেছে যা বুঝায়-গলার রশি যা গলার চতুর্পার্শ্বে বাধানো অবস্থায় লাগানো থাকে। এটা থেকেই রাস্তা সম্পর্কে তাকলীদ শব্দটি এসেছে –গলারফিতার মতই একজন অনুসরণকারী একটি ফতোয়ার ক্ষেত্রে সে একজন মুজতাহিদের সাথে লেগে থাকে।
পরিভাষাগত সংজ্ঞায়ন(Technical Defination) :
ইমাম আশ-শাওকানি র. এর মত তাকলীদ হল –কারো প্রমানহীন কথার অনুসরণ করা।
আমাদের নোটে রাখা গুরুত্ত্বপুর্ণ এই বিষয়গুলো যে ,এই বিষয়টি কিছু জিনিসকে সরিয়ে রাখে…রাসুল সা. এর কথা, ইজমার অনুসরণ, অনভিজ্ঞ লোকের ক্ষেত্রে কোন মুফতির ফতোয়া অনুসরন এবং বিশ্বস্থযোগ্য কোন সাক্ষীর প্রমানের ক্ষেত্রে বিচারকের বিবেচনা-যেহেতু তাদের কর্তৃত্ব বা প্রমানের বিশ্বস্থতা একবার স্থাপন হয়ে গেছে।রাসুল সা.এর কথা ও ইজমা এ দু’টিই নির্ভরযোগ্য তথ্যের বা প্রমানের উতস হিসেবে আসবে ঐসব লোকদের জন্য যারা এগুলো শনাক্ত করতে পারবে।একজন অনভিজ্ঞ লোকের ক্ষেত্রে কোন মুফতির মতামত(Statement) অনুসরণ ইজমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । কেননা একজন বিশ্বস্থ সাক্ষীর মতামত বিচারকের বিবেচনার নিয়মের মধ্যেই পড়ে-এটার বিশ্বস্থতা বা উতস কুরান-সুন্নাহ উভয় থেকেই পাওয়া যায়-আদেশ থেকে সাক্ষ্য নেওয়া, যেমন নেওয়া যায় ইজমা থেকে।
তাকলীদের বিষয় থেকে আরো যেসব বিষয়গুলো বাদ যাবে-হাদীস ব্যাখ্যাকারীদের ব্যাখ্যাসমুহ ; যেহেতু তাদের অবস্থান ইতোমধ্যেই প্রামাণীকরণ ও বৈধতার পক্রিয়াধীন রয়েছে।অধিকন্তু,এগুলো শুধুমাত্র বর্ণনাকারীদের মতামতই নয়,বরং যার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কেও ।
আরো ভালো সংজ্ঞা পাওয়া যায় ইবনে হুমাম(মৃত্যু-৮৬১ হিজরী) এর “তাহরীর” এ :
“তাকলীদ হল এমন কারো মতামতের অনুসরণ করা যে প্রমানহীন-যাকে বিশ্বস্থ উতস হিসেবে শনাক্ত করা হয়নি(অর্থাস প্রমানহীন থাকার কারণে তার মতামত বিশ্বস্থ নয়)”।
আল-কাফফাল(মৃত্যু-৩৬৫ হিজরী)পরামর্শ দেন এই বিষয়ে –
“কোন মতামত এমন কারো কাছ থেকে নেওয়া যখন জানা যায়না যে সে কোথা থেকে এটা পেয়েছে ”
শাইখ আবু হামিদ আল-আশফারাইনী(মৃত্যু-৪০৪ হিজরী)ও উস্তাদ আবু মানসুর আব্দুল কাহির আল-বাগদাদী(মৃত্যু-৪২৯ হিজরী),তারা দুজনেই বর্ণনা করেন-
“এমন কারো কাছ থেকে কোন লিগাল মতামত গ্রহন করা যার বিশ্বস্থাতা প্রতিষ্ঠিত নয়-সাক্ষ্যপ্রমানহীন ব্যক্তি”
কোন একটি মাযহাব মানার ক্ষেত্রে নিয়ম তাকলীদ বিষয়ে তিনটি মতামত আছে :
- কোন মাযহাবের অনুসরণ আবশ্যক
- তাকলীদ করা নিষিদ্ধ ও ইজতিহাদের আবশ্যকতা
- ঐ লোকের তাকলীদ করা আবশ্যক যে ইজতিহাদের করার লেভেল অর্জন করতে পারেনি
প্রথম মত : মাযহাবের অনুসরণ বাধ্যতামুলক
প্রথম মতানুসারে তাকলীদ করা সবার জন্য বাধ্যতামুলক-সে অনভিজ্ঞ বা পারদর্শী লোক হোক না কেন ।এটা আধুনিক স্কলার বা আলেমদেরকে যে কোন ধরণের ইজতিহাদ করতে নিষেধ করে ।বরং ইজতিহাদ করতে তারা তত্ত্বগতভাবে নিষেধ বলে বিবেচনা করে ও বাস্তবিক দ্রৃষ্টিকোন থেকে অপ্রচলিত বা সেকেলে মনে করে-মনে করে ইজতিহাদের দরজা বা সুযোগ তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দীতে বা তার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে ।
এই মতামতটি অপরিহার্যভাবেই চার মাযহাবের কোন একটি মাযহাবের তাকলীদ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ধর্মীগত বাধ্যতামুলক মনে করে । যারা এই মতটি গ্রহন করেছে তারা তাদের অনুসরণীয় মাযহাবের বাহিরে আধুনিক স্কলারদের মতামতকে অনুমতি দেয়না । প্রচলিত এই চার মাযহাবের অনুসরণ থেকে বের হয়ে অন্য কোন মাযহাব বা মতামত অনুসরণ করা তাদের নিকট কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়(যদিও সেগুলো কোন সাহাবা বা তাবিয়ী থেকে আসুক না কেন )।
যারা এই দৃষ্টিকোন ধারণ করে তারা যদি প্রচলিত মতামত ও লোককথা আরেকটির উপর অগ্রাহ্য করে বা অধিক পছন্দনীয় মনে করে তবে তারা তাদের স্বাধীন ইজতিহাদী গবেষণা প্রত্যাখ্যানে আরো শক্তিশালী হয়-যদিও কোন বিষয়ে আংশিক ইজতিহাদ হোকনা কেন ।তারা এই ইজতিহাদকে প্রত্যাখ্যান করে কোন পরিরবর্তনীয় পরিস্থিতির বিবেচনা ছাড়াই-যেগুলো মানবজীবন তৈরি করে,চিন্তা-মতামত ও আদর্শে যা মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এগুলো তারা করে একটি বিশ্বাস থেকেই আর তা হল ইজতিহাদের দরজা প্রতিরোধ করতে হবে।
পরবর্তী কিছু আলেম চার মাযহাবের কোন একটি বাধ্যতামুলক অনুসরনের ব্যাপারে কথা বলেন। শেইখ সাওবী আল-মালিকী(Sawy মৃত্যু-১২৪১ হি),যিনি –“হাশিয়া”(-ব্যাখ্যা)লিখেন ইমাম আল-দারদির ফিকহের(Jurisprudence)বিষয়ে বই “আশ-শরহ আস-সাগীর” এর। এবং আরেকটি ব্যাখ্যা লিখেন তাফসির আল-জালালাইন এর উপর । তিনি বলেন :
“চার মাযহাব ছাড়া আর কোন মাযহাবের ক্ষেত্রে তাকলীদ করার অনুমতি নেই,যদিও সেটা কোন সাহাবার মতামত,ছহীহ হাদিস অথবা কোরানের কোন আয়াতের সাথে মিলে যায়-কেননা যে এই চার মাযহাবের কোন একটির বাহিরে সে পথভ্রষ্ট এবং অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করতেছে। সম্ভবত এটা তাকে ঈমানহীনতার দিকে নিয়ে যাবে,আপাত দৃষ্টিতে কুরান-সুন্নাহ থেকে নেওয়া হলেও এটার ভিত্তি বিশ্বাসহীনতা-ঈমানহীন”
এই শাইখের কট্ট্ররতা লক্ষ করুন যে ইমাম শাওকানী র. এর সমসাময়িকই ছিল –কিন্তু তাদের গভীর চিন্তার মধ্যে কত বিস্তর পার্থক্য ছিল । তিনি চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ করা নিষেধ করেন যদিও কোন মতামত বা ফতোয়া কোন সাহাবার রা.এর বক্তব্যের সাথে মিলে যায়,তার চেয়েও নিকৃষ্ট কথা তিনি বলেছেন তা হল-যদিও সেটা রাসুল সা.এর কোন ছহীহ হাদীসের সাথে মিলে যায়,এটার চেয়েও আরো কত নিকৃষ্ট কথা তিনি বলেছেন আর তা হল-যদিও এটা কোরানের আয়াতের সাথে মিলে যায় !(তারপরো সাহাবার কথা,ছহীহ হাদীস বা কোরানের আয়াত বাদ দিয়ে(মিলে গেলেও) মাযহাবের তাকলীদ করা বাধ্যতামুলক !!)
আরেকটি অত্যুক্তিমুলক অতিরঞ্জন দেখুন –চার মাযহাবের(কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়েও) বাহিরে কোন লোককে “পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্ট করতেছে” বলে বিবেচনা করছে এবং এটা কোন ঈমানহীনতার দিকে পরিচালিত করবে !! এই সব কিছুই হঠকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা এবং অনুসন্ধানী স্কলার বা আলেমের সর্বসম্মত মতের বিরোধিতা। তাকলিদ করা বাধ্যতামুলক-এই ধরণের মত পরবর্তী ধর্মীয় গোষ্টি মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সমুহে নেওয়া হয়ছিল অনেক পরের শতাব্দীতে ।সালাফ(প্রথম যুগ-বংশধর) বা মাদ্রাসার পন্ডিতরা এটা শিক্ষা দিয়েছিল তাদের অধস্থনদের ও এইসব ছাত্রদের নিকটই এটা সঞ্চারণ করতে শুরু করেছিল-
“যে ব্যক্তি কোন আলেমের তাকলীদ করে সে আল্লাহর নিরাপত্তা পায়”
আমি আল-আযহারে মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে এই সব শিক্ষার কথা মনে করি যখন তাওহীদের উপর ক্লাস নিতেন ।আমার বাধ্যতামুলক পড়ার মধ্যে কারানীর জাওহারাহ ও তার আল বাজুরীর ব্যাখ্যা-যেখানে লেখক বলেন-
“ইমাম মালেক এবং অন্যান্ন আলেম যেমন আবু কাসেম যারা উম্মতকে সৎ পথ দেখিয়েছেন-তাকলীদ করা শিক্ষিত লোকদের জন্য ফরজ-কেননা একজন যে কোন ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ উপলব্দির দিক থেকে কোন একটির দিকে সম্পৃক্ত থাকে”
আল-কাসেম এখানে বিশিষ্ট সুফি আল-জুনায়েদ ইবনে আহমদ র.(মৃত-২৯৭ হি) এর কথা উল্লেখ করেন । এটা ইংগিত করে যে চার মাযহাবের ইমামসমুহের মধ্য থেকে কোন একজন ইমামকে অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর বাধ্যতামুলক।
বিশেষত ইমাম মালেক র.কে উল্লেখ করা যেতে পারে কেননা লেখক মালিকী মাযহাবের । তিনি বলেন- একজন ইমামকে অনুসরণ করতে হবে সেইভাবে যেভাবে সুফি ইমামরা(আত্মার) উন্নয়নের (Tarbiyah-self development) ধাপগুলো অনুসরণ করে। যেমন জুনায়েদের উত্তরাধিকার ছিলেন তার আলেমদের সাথে –তার তরিকতের(method)পুর্ণতা, অটুট নির্দেশনা,আর তার চরমপন্থা ও বিদআত থেকে দুরত্ত্বের কারণে ।
কিছু কিছু স্কলার বলেন আকীদার ক্ষেত্রে কোন একজন ভালো ইমামের নির্দেশ অনুসরণ জরুরী।এর মধ্যে রয়েছে-আবুল হাসান আল-আশয়ারী(মৃ-৩৩৪ হি), অথবা আবুল মানসুর আল-মাতুরিদী।
তবে পুর্ব(মাগরিব)দেশসমুহের(লিবিয়া,তিউনিশিয়া,আলজেরিয়া,মরক্কু ও মৌরতানিয়া)জ্ঞানীদের ভাতৃবৃন্দ ও জায়তুনা,কাইরাওনিয়া,ও অন্যান্ন প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটদের মাঝে প্রচলিত একটা নিয়ম হল আশয়ারী মাযহাব অনুসরণ করতে হবে আকীদার ক্ষেত্রে,ফিকহের ক্ষেত্রে মালিকী মাযহাব,আর সুফির ক্ষেত্রে জুনায়েদ রা.এর পথনির্দেশনা ।
এই মত এর অবিচ্ছেদ্য ও সম্ভাব্য খুটীনাটি বিষয়গুলো এক সাথে বললে যে বিষয়গুলো অন্তুর্ভুক হবে…
- প্রত্যেক লোকের তাকলীদ করা ফরজ,যদিও সে জ্ঞানী লোক হোক না কেন ।
- তাকলীদ শুধুমাত্র চার মাযহাবের কোন একটি মাযহাবের ক্ষেত্রেই হবে ।এছাড়া এদের বাহিরে অন্য মাযহাবের কোন মতামত নেওয়া বিষেধ ।
- চার ইমামের কোন একজনের তাকলীদ বাধ্যতামুলক।তাই এই চার ইমামের বাহিরে যাওয়ার অনুমতি নেই যদিও কোন কোন বিষয়ে এই মাযহাবসমুহের অবস্থান দুর্বল বলে সুস্পষ্ট দেখা যায় ।
- ইজতিহাদের দরজার বন্ধের ব্যাপারে সবাই ডাকা ও ইজতিহাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হওয়া যদিও তা একপার্শ্বিক হোক না কেন ।
- নিজের মাযহাবকে অন্য মাযহাব থেকে অধিকতর ভালো মনে করে এবং একটি আত্মকেন্দ্রিক মনের সীমাবদ্ধতা(Ethnocentric Mind Frame) তৈরি করে ।
তাকলীদের ব্যাপারে এই ধরণের দৃষ্টিভংগির বিষয়ে অনেক আলেম বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন-তাদের মধ্যে রয়েছে—ইবনে আব্দুল বার্, ইবেন হাজম,ইবনে তায়মিয়াহ,ইবনুল কাউয়ুম,আস-সানানী ,আশ-শাওকানী ও আল-দেহলভী সহ আরো অনেকে।
দ্বিতীয় মত : তাকলীদের নিষিদ্ধতা ও ইজতিহাদের আবশ্যকতা
দ্বিতীয় মতটি প্রথমটির ঠিক বিপরীত-তাকলীদের বিরোধিতা ও সবার জন্য ইজতিহাদের বাধ্যবাধকতা ।যারা এই মতামতটি ধারণ্ করেন তারা বলেন যে, কুরান-সুন্নাহ থেকে সরাসরি আইনগত নিয়ম-বিধান(Legal Ruling) নেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামুলক। তারা চার মাযহাবের অনুসরণ করা তীব্রভাবে বিরোধিতা করে,এমনকি তারা এই সব প্রপাগান্ডা-প্রচারণাকে প্রচন্ডভাবে সমালোচনা করে। সম্ভবত তাদের কিছু লোকের তাকলীদের সমালোচনা বা তাকলীদের উপর আঘাত অতিরিক্ত হয়ে যায় কেননা তারা নিজেরাই মাযহাবীদের প্রবল আঘাত করে আর তাদের কিছু লোক মাযহাব প্রতিষ্ঠাকারীদেরকে মিথ্যা কলংকও আরোপ করে বা অপবাদ দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে, এই দৃষ্টিভংগিদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রস্তাবক হল,যাকে আমরা বিখ্যাত যাহিরী ফিকহবিদ হিসেবে জানি, সেই –আবু মুহাম্মদ ইবনে হাজম ।তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন তার মধ্যে-Principles of Jurisprudence-উসুল আল-ফিকহ এর ভিত্তি নিয়ে “আল-আহকাম ফি উসুল আল-ফিকহ”, তুলনামুলক ফিকহ নিয়ে “আল-মুহাল্লা” এবং ধর্মের ইতিহাস,বিভিন্ন উপদল ও অন্যান্ন বিষয় নিয়ে “আল-ফাসল ফিল মিলাল ওয়ান নিহাল” অন্যতম।
এবং পরবর্তীদের মধ্য থেকে সেরা স্কলার-ইমাম আশ-শাওকানী,যিন এই মতামতের উপলব্ধি বিস্তৃতি করতে বই লিখে সহায়তা করে-তার বই সমুহের মধ্যে-“ইরশাদ আল ফুহুল”, “আস সাইল আল-জারার”, এবং তার চিঠি “আল-কাওল আল মুফিদ ফিল ইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদ” অন্যতম।তিনি দৃঢ়ভাবেই তাকলীদকে অস্বীকার করেছেন যদিও তা ইবনে হাজমের চাইতে কিছুটা কম দৃঢ় ছিল।
আমাদের সময় একটা গ্রুপ আছে যারা হাদীস বিষয়ে সেরা ,নাসিরুদ্দিন আলবানীসহ তার অনুসারীরা পুরোভাগ এই দলে আছে।যারা এই মতের বিরোধী তারা এদেকে নাম দিয়েছেন “লা মাযহাবী” বা “যাদের কোন মাযহাব নেই”-কারণ তারা কোন মাযহাব গ্রহন করা প্রত্যাখ্যান করে ; তা কোন আলেমের জন্যই হোক বা অনভিজ্ঞ ব্যক্তির জন্যই হোক না কেন । এই মাযহাবহীনদের বিরোধিতাকারীরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক আরটিকেল লিখার মাধ্যমে।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-তুরকীর শেইখ মুহাম্মাদ জাহির আল-কাউসার এর “আল লা মাযহাবিয়া কেনতারা ইল্লা আল-লা দ্বীনিয়া ” এবং হামায়ী আলেমরা যেমন-শেইখ মুহাম্মাদ আল-হামিদ, ড. মুহাম্মাদ সাইদ রামাদান আল-বুতির বই “আল লা-মাযহাবিয়া আখতার বিদাহ তাহাদ্দাত আশ-শারিয়াহ আল -ইসলামিয়াহ” অন্যতম।
আবারো আমরা এই চরমপন্থার অবিচ্চছেদ্য ও খুটিনাটি বিষয়গুলো সারসংক্ষেপ নিম্নরুপ দেখাবো
- সবার উপর তাকলীদের নিষিদ্ধতা যদিও অনভিজ্ঞ ব্যক্তির ইজতিহাদের বিষয়সমুহের ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ নেই।
- অধিক দাবির কারণে অধিকাংশ যুবকরা(যদিও তারা কৃত্রিম বা অমার্জি) বলে যে তারা মুজতাহিদিন এর পর্যায়ে পৌছে গেছে।
- পুর্ববর্তী সেরা আলেম ও আগেকার মুজতাহিদীনদের তারা বিদায় দেওয়ার স্পর্দা বা দুংসাহস দেখায় ।
- মাযহাবকে উম্মাহর জন্য অসম্মানজনক বা অবজ্ঞাপুর্ণ মনে করা হয় যদিও এগুলোতে অনেক উপকারী বিশাল জ্ঞানভান্ডার রয়েছে।
- এই মতের কিছু কিছু অনুসারী মাযহাব ও তাদের মাযহাবী ইমামকে গালির ক্ষেত্রে ব্যাপক সীমালংঘঙ্কারী ।
- আক্ষরিক বা লিটারালিস্ট এই দলের বৃদ্ধির প্রবণতা কারণে তাদেরকে একটা পয়েন্টে “নতুন জাহিরিয়া” নাম দিয়েছে।
- এই মতের উপর উম্মাতের তর্কটা নিতান্তই ছোট ছোট ফিকহী মতপার্থক্যের উপর- যা তাদেরকে অন্তবিরোধের দিকে ধাবিত করেছে।
- যারা বিরোধী তাদের প্রতি অভিযোগখ্যাপন করেছে ও বলে দিয়েছে যে –একমাত্র তারাই উপযুক্তভাবে কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণ করতেছে।
ইমাম আশ-শাওকানী ও তাকলীদ
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী আশ-শাওকানী র. (মৃত-১২৫০ হি) ছিলেন তের শতক হিজরীর একজন উচু মাপের পুর্ণজাগরণ ও ইজতিহাদের নেতা ,যা তার ইজতিহাদের বই থেকে সুস্পষ্ট ।উদাহরণ দেওয়া যায়-বই আছার এর ব্যাখ্যা (যা যাইদী বা হাদুভী এর ফিকহের মুল বই হিসেবে বিবেচিত),তিনি সেখানে স্বাধীন ইজতিহাদের পথে আনন্দে ভেসে বেড়ান ;তিনি কুরান-সুন্নাহ ব্যবহার করে নিজেই আইনগত-ধর্মীয় মতামত দেন যা সেই সময়ের চার বা আট মাযহাবের বাহিরে ছিল।তার “নাইলুল আওতার” হল আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ যেখানে তিনি ইবনে তায়মিয়া র. এর “মুন্তাখাব আল-আখবার আহাদিস সাইয়্যিদ আল আখবার” এর ব্যাখ্যা করেন।এই বইটি সুন্নী ও সুন্নী নয় এমন মাযহাবীদের কাছেও আধুনিক ফিকহের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্ত্বপুর্ণ সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে আজ অবধি পর্যন্ত। আরেকটি উদাহরণ হল তার “আল-দারারি আল-মুওয়াইয়াহ”(যা আল-দুরার আল বাইইয়াহ এর ব্যাখ্যা) যেখানে তিনি স্বাতন্ত্র ফিকহের সারাংশ করেন।
প্রকৃত পক্ষে ,ইমাম আশ-শাওকানী র. তীব্রভাবে তাকলীদের বিরোধীতা করে ও ইজতিহাদের কথা বলেন তার একাধিক বই এ।
- ফিকহের বুনিয়াদি সুত্রসমুহের উপর তার বিখ্যাত বই “ইরশাদ আল-ফুহুল”।
- তার চিঠি “আল-কাওল আল-মুফিদ ফিল আদিল্লাতিল ইজতিহাদ ওয়াল তাকলীদ”।
- তার বই “আদাব আল-তালিব ওয়া মুন্তাহা আল-আরাব”।
- তার বিশাল কাজ “আস সাইয়াল আল-জারার”
আশ-শাওকানী তাকলীদ এর অনুসারীদের যুক্তির ভিত্তির কিছু বিকল্প ব্যাখ্যার প্রস্তাব দেন (যেমন তারা তাকলীদের ভিত্তির যুক্তি-“যদি তোমরা না জান তবে যাদের স্মরণে আছে তাদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও”-আল-কোরান সুরা নাহল-৪৩ এবং রাসুল সা. এর বাণী-“তারা যদি না জানে তবে কি তারা জিজ্ঞেস করেনা ? বিভ্রান্তির চিকিতসা হল অনুসন্ধান করা বা জানতে চানতে চাওয়া”)।ইমাম আশ-শাওকানী পরিষ্কার করে বলেন যে এই সব প্রত্যেকটা বিষয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের তাকলীদ চাপায় না(অর্থাৎ এইসব দলীল দ্বারা এটা বুঝায় না যে প্রত্যেকটা বিষয়েই কোন আলেমের তাকলীদ করতে হবে ) বরং এটা বুঝাচ্ছে যে যাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিচরণ আছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেমনটা রাসুল সা. ও তার সাহাবা রা. এর সময়কার রীতি ছিল।
আশ-শাওকানী ইমাম ইবনুল কাইয়ুম র. এর লেখা থেকে উপকৃত হন-যা তাকলীদকে প্রত্যাখ্যান করেছিল-এবং আরো ইমাম ইবনে আব্দুল বারর ,ইবনে হাজম ,এদের লেখা ও তার পুর্ব্বর্তীদের লেখা থেকেও উপকৃত হন। “ইজতিহাদে দরজা বন্ধ” এই বিষয়টির বিরোধিতাও করেন তিনি-তিনি এটাকে নিন্দনীয় বিদয়াত মনে করেন।তিন বলেন-আল্লাহর অনুগ্রহ অসীম,এবং এটা একটা নির্দিষ্ট যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যাবেনা, অথবা কোন একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টির দ্বারা একচেটিয়া অধিকারত্ত্বে নিয়ে নেওয়া যাবেনা।বরং এটা ঐসব লোকদের জন্য খোলা আল্লাহ যাদের এর যোগ্যতা দান করেছেন।
আশ-শাওকানী ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন ও প্রকৃত ও স্বাধীন ইজতিহাদ গবেষনার আহবান জানান। তিনি কোন পরিচিত মাযহাবের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না তা ফিকহের বুনিয়াদি মুলনীতিমালার ই হোক বা প্রকৃত ফিকহ ই হোক-বরং তিনি সর্বপ্রথম জাইদী থেকে বের হয়ে নতুন করে শুরু করেন । এমন কি তিনি নিজেই বুনিয়াদি মুলনীতিমালা উন্নয়ন করেন,যা তিনি তার গ্রন্থ “আল-ইরশাদ আল ফুহুল ইলা তাহকীক আল হাক্ক মিনাল ইল্ম আল-উসুল” তে ব্যাখ্যা করেন।
অবশ্য তিনি স্বাধীন আইনগত যুক্তি ও রায় এর ব্যবহারের বিরোধিতা করেন ফিকহের ক্ষেত্রে এবং পুর্ণভাবে রায় মাযহাবের বিরোধিতা করেন তার যুগে । তার পরিবর্তে তিনি সম্পুর্ণুরুপে ওহীর উপর গুরুত্ত্বারোপ করেন-তিনি বলেন যে ধর্ম ইমামদের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি বরং ধর্মের নির্দিষ্টতামুলক(Seal)বর্ণনা ,মুহাম্মাদ সা. এর মাধ্যমে এসেছে।তিনি বিশ্বাস করেন যে যে সব অনভিজ্ঞ লোকেরা ইজতিহাদ করার ব্যাপারে বৈশিষ্টসম্পন্ন নয় তারা কোন আলেমকে খুজে তার কাছ থেকে জ্ঞান নিয়ে কুরান-সুন্নাহর উপর তাদের অবস্থান করার চেষ্টা করবেন এবং ঐসব আলেমদের মতামতের উপর ভিত্তি করবেনা।
আমি শাওকানীর সাথে কিছু বিষয়ে একমত আর কিছু বিষয়ে ভিন্নতা অবলম্বন করি।আমি তার সাথে যেই সব বিষয়ে একমত সেগুলো হল…
- আলেমদের প্রতি তার স্বাধীন ইজতিহাদের(গবেষণার)প্রতি আহবান।
- উম্মাহর সবার উপর তাকলীদ চাপানো-এর প্রত্যাখ্যান ।
- ঐসব লোকের ব্যাপারে তার অবস্থান যারা বলেন যে প্রত্যেকটা বিষয়ে কোন একটি মাযহাবের আবশ্যকতা।
- যারা প্রত্যেকটি বিষয়ে কট্ট্রভাবে নির্দিষ্ট মাযহাবকে অনুসরণ করে,যদিও সেখানে কোন বিষয়সমুহে তাদের মাযহাবের দলীলের দুর্বলতা রয়েছে তা প্রতিয়মান হয়-এটাও ইমাম শাওকানী প্রত্যাখ্যান করেন।
- ইজতিহাদের দরজা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতে বন্ধ হয়ে গেছে এত ধারণার প্রত্যাখ্যান।
- মানুষের মতামতের উপরে উম্মাতের সবাইকে তিনি কুরান-সুন্নাহর অনুসরণের দিকে উতসাহিত করেন ।
যাইহোক,আমি সাধারণ মানুষের উপর তাকলীদের নিষিদ্ধতা প্রচন্ডভাবে বিরোধিতা করি এবং শধুমাত্র কোন একটি মাযহাবের অনুসরণে তার নিষিদ্ধতাও।আমি এমন কিছু দেখিনা যা মানুষকে কোন একজন ইমাম অনুসরণ করা ও কোন মাযহাবের সাথে থাকা বিরত রাখে-সেটা ইমাম আবু হানিফা,মালিক,শাফিয়ী আহমাদ,যাইদ,আল-হাদি ,জাফার ও অন্য যে কোন মাযহাবই হোকনা কেন।শরীয়ার ভিত্তিতে এটা অনুমদিত,কিন্তু বাধ্যতামুলক নয়। কিন্তু একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির জন্য ভালো অবস্থান হল তার কোন মাযহাব না রাখা। বরং তার মাযহাব হবে ঐসব স্কলার যাদের থেকে কোন বিষয় জিজ্ঞেস করে জেনে নিবে।যেহেতু সে তার মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাবে যাওয়ার অনুমতি আছে ,তাই সে যে কোন বিষয়ে যে কোন আলেমের কাছে সে জানতে চাইতে পারে যা তার কাছে গুরুত্ত্বপুর্ণ মনে হয় ।সে যদি ইচ্ছা করে এক মাযহাব ছেড়ে আরেক মাযহাবে যাবে,তবে যেতে পারে , যদি সে বিশ্বাস করে যে ঐ মাযহাবের দলীল-প্রমান অধিকতর শক্তিশালী।
আমি ইমাম আশ-শাওকানী সাথে আরো ভিন্নমত পোষণ করি ফিকহে শাওকানীর স্বাধীন লিগাল যুক্তির ব্যবহার ও রায় এর বিরোধিতার ক্ষেত্রে,কেননা সেটা শরীয়ার বিরোধী হয় যায়।সত্য হল রায়(যুক্তি) ছাড়া কোন ফিকহ নেই।নিন্দনীয় রায় হল যেটা স্পষ্ট কিতাবের(কুরান-সুন্নাহ)বিরুদ্ধে যায়।অতএব রায় বা যুক্তি আসবে সেই স্থানে যেখানে কিতাবের ভিত্তি নেই আর রায়কে তখন ব্যবহার করা হবে প্রতিষ্টিত মুলনীতিমালা ও শরীয়র উচ্চত্তর উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে কুরান-সুন্নাহ ভালো করে বুঝার জন্য, এটা অবপরিহার্য।ঐ সমস্ত ক্ষেত্রসমহে রায় অবশ্যই থাকবে যেখানে সুনির্দিষ্ট আইনগত নমনীয়তার(দুর্বলতার) কারণে সেগুলোর প্রতি ভালো করে লক্ষ করা হয়নি বা যেই সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিতাবের অভাব রয়েছে যা স্পষ্টভাবেই অন্যকিছু নিতে হয়।
এই সব ক্ষেত্রগুলো :
- ধর্মীয় কিতাব(কুরান-সুন্নাহ) ব্যবহার করে কিয়াস(সাদৃশ্যের সাথে যৌক্তিকতার পদ্ধিতি)করা।
- ইসতিহসান (লিগাল অগ্রাধিকারের পদ্ধতি)করা হয় স্পষ্ট একদিকে সরে যাওয়ার জন্য কিন্তু দুর্বল কিয়াস কে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য কিন্তু তা অধিক সুপ্ত থাকে।অথবা
- জনস্বার্থের জন্য ইসতিসলাহ(অধিকতর উপকার অন্বেষণ)প্রয়োগ,যা বৈধ শর্তাপেক্ষে।অথবা স
- নির্দিষ্ট স্থানের প্রথা(উরফ) ক্ষেত্রে।
- সাদ্দ আল-ছারাই বা মন্দের পথরোধ বা
- ইসতিসহাব(অবিচ্ছিন্নতার অনুমিতি বা সম্ভাবনা)ইত্যাদি
এই সব গুলো ক্ষেত্রই রায় এর ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করে।একজন ফিকহবীদ কি এগুলো ব্যবহারের উপরে(বাইরে) থাকতে পারে? এই কারণেই ,পছন্দনীয় ব্যক্তিসমুহ যেমন ওমর,ওসমান,আলী,ইবনে মাসউদ,যাইদ,ইবনে আব্বাস ও অন্যান্ন লোকদের ফিকহ,এটা(রায়)থেকে কি তারা মুক্ত ?
রায় ছাড়াও কি তথাপি কিতাবগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব ? বনু কুরায়যায় যাওয়ার পথে আসরের সালাত আদায় করার সময় রাসুল সা.এর সাহাবারা কি রায়(যুক্তি) ব্যবহার করেনি ? ইবনে তায়মিয়ার র.যেমন প্রস্তাব দিয়েছে-যারা সালাত আদায় করেছিল তারাই অধিক সঠিক ছিল যারা সালাত আদায়ে দেড়ি করেছিল যতক্ষণ না তারা তাদের গন্তব্যে পৌছে যায় কিন্তু সেটা ছিল আসরের সালাত অতিক্রম সময়।
এই উদাহরণগুলো কি কুরান ও সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে রায়(যুক্তি)এর ব্যবহার শরীয়ার উচ্চতর লক্ষ্য নয় ?
দুর্ভিক্ষের সময় চুরি করার শাস্তি মুলতবি কি ওমর রা.এর রায়(যুক্তির) উদাহরণ নয় ? রক্তপন এর দায়িত্ত্ব গোত্র থেকে রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত করার তার সিদ্ধান্ত কি রায় এর নমুনা নয়? ইরাকের নির্দিষ্ট জয় করা অঞ্চল মুসলিমদের বন্টন করে দেওয়ার বিপক্ষে তার সিদ্ধান্ত কি রায় এর নমুনা নয় ? আহলে কিতাবধারী নারীদের বিবাহের নিষেধ ,মুসলিম নারীদের উপর প্রভাবের ভয় থেকে,কি তার রায় এর উদাহরণ নয় ? আসল ভাই ও সৎ ভাই(মা এর দিক থেকে) এর উত্তরাধিকার আইন একত্র করার সিদ্ধান্ত-যদিও অন্য নিয়ম আছে,কি রায় এর নমুনা নয় ? স্বামী যখন মৃত্যু আসন্ন রোগে ভুগছে এই অবস্থায় তালাক উচ্চারণ করার শর্ত নেই-এটা কি উসমান রা.এর যুক্তি বা রায় এর অবস্থান ছিলনা ? আবু বকর ও অন্যান্ন সাহাবা রা.কর্তৃক বর্ণিত আছে –
আমি আমার রায় বা যুক্তি দিয়ে লিগাল আদেশ জারি করি।আর এই কারণে এটা যদি সঠিক হয় তবে তা আল্লাহ থেকে আর যদি ভুল হয় তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কি ভুল থেকে মুক্ত নয় ?
যখন মুয়াজ রা.কে তিনি ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন তখন কি মহানবী সা. মুয়াজ রা.এর উত্তরগুলো গ্রহন করেননি ? যখন তিনি বলেছিলেন-তুমি কি দিয়ে ন্যায় বিচার করবে ? মুয়াজ রা.উত্তর দিয়েছিল যে তিনি আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফয়সালা করবেন,তারপর রাসুল সা.এর সুন্নাহ দিয়ে।আর যদি কিতাব বা সুন্নাহতে উত্তর না পাওয়া যায় তবে আমি আমার যুক্তির মাধ্যমে ইজতিহাদ করব।
রাসুল সা.এর সাহাবারা কি তাদের যুক্তি ও উপলব্ধির ভিন্নতার কারণে কিছু নিয়মের মাঝে মতভেদ করেনি ?
তৃত্বীয় মত : ঐ লোকের তাকলীদ করা আবশ্যক যে ইজতিহাদের করার লেভেল অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম মতের মত এটি সমর্থকদের উপর তাকলীদকে চাপিয়ে দেয়না বা দিত্বীয় মতের মত নিষেধও করেনা। বরং এই মত কিছু মানুষের জন্য তাকলীদ অনুসরণ করার অনুমতি দেয় আর কিছু লোকের জন্য নিষেধ করে।ইমাম হাসান আল-বাসরি তার “20 Principles of Understanding”( উপলব্ধির ২০টি মুলনীতি)র একটিতে আলোচনা করেন।
“প্রত্যেকে মুসলিম যারা (Legal Deduction)আইনগত অবরোহ(Reasoning from the general to the particular)ও ফিকহ এর যুক্তি বুঝার স্তরে পৌছেনি তাদেরকে ইসলামী ফিকহের ইমামদের কাজসমুহকে অনুসরণ করার জন্য উতসাহিত হয়।একজন ইমামকে অনুসরণ করার সময় একজন লোককে অবশ্যই ইমামের যুক্তি বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।যখন একজন ইমামের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে,একজনের উচিত উপযুক্ত যুক্তিসমৃদ্ধ যে কোন ইমামের সঠিক পথ গ্রহন করা। এর সাথে,একজন মুসলিমকে আইনগত অবরোহ পদ্ধতি ও ফিকহ উপলব্ধির লেভেল অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টাসমুহ চালিয়ে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।”
এভাবে তিনি তাকলীদ বা একটি মাযহাবকে অনুসরণ বাধ্যতামুলক করেননি,আর তিনি নিষেধও করেননি,তিনি এর অনুমতি দিয়েছেন,কিন্তু সবার জন্য নয়।এটা আইনগতভাবে অনুমদিত শুধুমাত্র ঐ সব লোকের জন্য যারা-““প্রত্যেকে মুসলিম যারা (Legal Deduction)আইনগত অবরোহ(Reasoning from the general to the particular) এর যুক্তি বুঝার স্তরে পৌছেনি”।তার মানে এটা অনভিজ্ঞ লোকদের জন্য যারা কুরান-সুন্নাহ থেকে নিয়ম(Rulings)বা্র করার ক্ষেত্রে বৈশিষ্টসম্পন্ন নয় বা ইজমা ,কিয়াস,ও অন্যান্ন পদ্ধতিসমুহ যেগুলো এই সব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যেমন ইসতিসলাহ,উরফ,ইসতিসহাব,ও আমাদের সম্মুখের শরীয়ার অন্যান্ন বিষয়াদি জানেনা,(তাদের জন্য মাযহাব বা তাকলীদ(অনুমদিত বা)।
অনুসরণ বনাম অন্ধ অনুকরণ
Following vs.Blindly Imitating
উস্তাদ আল-বান্না তার প্রাজ্ঞতার মুলনীতিতে ইত্তিবা(অনুসরণ-দলীলসহ)কে তাকলীদের(অন্ধভাবে অনুকরন) উপর প্রাধান্য দেন।তিনি বলেন-“মুসলিমদেরকে ইসলামী ফিকহের কোন এক ইমামকে অনুসরণ(অনুকরণ নয়) করতে হয়”।আল কুরআনেও ইত্তিবা(আলে-ইমরান-৩১)(দলীলসহ অনুসরণ)শব্দটি ব্যবহার করে এই প্রসঙ্গে যা এটাকে প্রশংসাযোগ্য ও আইনগত গ্রহনযোগ্য করে তুলে।
ইব্রাহীম আ.এর বর্ণনার মাঝে এটা দেখা যায়-
“হে আমার পিতা,আমার নিকট জ্ঞান এসেছে যা আপনার নিকট আসেনি ,সুতরাং আপনি আমার অনুসরণ করুন ,আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো”(সুরা মারইয়াম-৪৯)
এই আয়াত যে কাউকে এমন একজন লোকের অনুসরণ করার আহবান জানায় যিনি এমন ক্ষেত্রে জ্ঞানী যা সে জানেনা।
আমরা মুসা আ. ও আল্লাহর বিখ্যাত সত বান্দার(খিযির আ.)ঘটনাতেও পাই-
“অতঃপর তারা সাক্ষাত পেল আমার বান্দাদের মধ্য হত একজন যাকে আমি অনুগ্রহ করেছি ও যাকে শিক্ষা দিয়েছি এক বিশেষ জ্ঞান।মুসা আ. বললেন-আমি কি আপনাকে অনুসরণ করতে পারি ? যাতে আপনাকে যেই সৎ পথ শিখানো হয়েছে আমি শিখতে পারি।” (সুরা কাহাফ-৬৫-৬৬)
মুসা আ. খিযির আ. এর অনুসরন করার(ইত্তাবিয়া) অনুমতি প্রার্থনা করলেন যাতে তিনি প্রশংসিত আল্লাহ যেই জ্ঞান তাকে দান করেছেন তা শিখতে পারেন। এটা দেখাচ্ছে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রসমুহে জ্ঞানী লোককে অনুসরণ করা নিন্দনীয় নয়।
ইমাম আবু উমার ইবনে আব্দুল বারর বলেন-জ্ঞানের উদ্দেশ্য হল বদান্যতা-যেইরকম সত্যিকার ভাবে এটা জানা সেইভাবেই এটাকে আত্মস্থ করা।কারণ যখন কোনকিছু কারো নিকট পরিষ্কার করা হয় ,তখন সে এটা জেনে যায়।পন্ডিতরা বলেন যে-যে ব্যক্তি তাকলীদ করে তার কোন জ্ঞান নেই,আর এই বিষয়ে সব পন্ডিত একমত।আবু আব্দুল্লাহ বিন খুওয়াইজ মিন্দাদ আল-বাসরি আল-মালিকী বলেন –
“তাকলীদ অর্থ এমন বর্ণনার দিকে ফিরে যাওয়া যেটির উল্লেখযোগ্য দলীল-প্রমান নেই।ইত্তিবা যা এমন বর্ণনার দিকে নির্দেশ করে যা বৈধ সত্যতাসহকারে গ্রথিত। ইত্তিবাই ধর্মে অনুমদিত,তাকলীদ নয়।“
ড: ইউসুফ আল কারজাভীর প্রবন্ধ হতে অনুবাদ করেছেন এনামুল হক হোমাইদ ।
STA-2.2
© 2013 by Ask Islam Bangla.