প্রশ্ন ৬ --> ইসলামে মাজহাব কী? মাজহাব কি নবী মুহাম্মাদ (সা) এর সময় থেকেই পরিচিত আছে?
উত্তরঃ
ইসলামে মাজহাব কীঃ
মাজহাব কথাটির অর্থ হচ্ছে চলার পথ।ইজতিহাদের সঙ্গে এর ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায়,কুরআন-সুন্নাহে যেসব বিধান-আহকাম প্রচ্ছন্ন রয়েছে,তা চিন্তা-গবেষনার মাধ্যমে আহরণ করা।যিনি এটি করেন,তাকে বলা হয় মুজতাহিদ।মুজতাহিদ কুরআন-সুন্নাহ থেকে যেসব বিধান-আহকাম আহরণ করেন,সেগুলোই হচ্ছে মাজহাব।অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিধানসমূহ আহরণ করে তার আলোকে মুজতাহিদগণ যেসব মতামত প্রদান করেন,তাকেই মাজহাব বলা হয়।
মাজহাব পালনের কথা এই জন্য বলা হয় যে, যেহেতু কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে মুজতাহিদ আলেমের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অধিকাংশ সাধারণ আলেম কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কী,আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে এই বাক্যটি? এই আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে-ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞ হন না। সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদীস কোনটি দুর্বল হাদীস,কোন হাদীস কি কারণে দুর্বল,কোন হাদীস কী কারণে শক্তিশালী,হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম অত্যন্ত বিরল। অথচ হাদীসের বর্ণনাকারী শক্তিশালী না হলে তার দ্বারা শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয় না।মুজতাহিদ আলেমগণ এসব বিষয় বিবেচনা করে রায় দিতে সক্ষম।সাধারণ আলেমদের সাথে এখানে তাদের বড় পার্থক্য।আহমাদ ইবন হাম্বল(র) মুজতাহিদ ফকীহ হবার জন্য ৫ লক্ষ হাদিস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকার কথা বলেছেন।(সূত্র ইমদাদুল ফাতওয়া ৪/৮৭)
একটি ছোট উদাহরণ পেশ করছি।এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-اقيموا الصلاة
অর্থঃ সালাত কায়েম কর। আরেক আয়াতে বলেছেন-إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেস্তারা নবীজীর উপর সালাত পড়ে। এই আয়াতের শেষাংশে এসেছে
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ হে মুমিনরা তোমরাও তাঁর উপর সালাত পড় এবং তাঁকে সালাম জানাও। {সূরা আহযাব-৫৬}
এই সকল স্থানে লক্ষ্য করুন-“সালাত” শব্দটির দিকে। তিনটি স্থানে সালাত এসেছে। এই তিন স্থানের সালাত শব্দের ৪টি অর্থ। প্রথম অংশে সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল “নামায” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিলেন যে,
তোমরা নামায কায়েম কর। {সূরা বাকারা-৪৩}
আর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও তার ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর উপর সালাত পড়েন মানে হল-আল্লাহ তায়ালা নবীজী সাঃ এর উপর রহমত পাঠান, আর ফেরেস্তারা নবীজী (সা) এর উপর সালাত পড়েন, মানে হল নবীজী সাঃ এর জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।
আর তৃতীয় আয়াতাংশে “সালাত” দ্বারা উদ্দেশ্য হল উম্মতরা যেন নবীজী সাঃ এর উপর দরূদ পাঠ করেন।
(كتاب الكليات ـ لأبى البقاء الكفومى)
এরকম অসংখ্য স্থান আছে, যার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। তাই একজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তির শরাপন্ন হয়ে তার গবেষনা অনুযায়ী উক্ত বিষয়ের সমাধান নেয়াটাই হল যৌক্তিক। এই নির্দেশনাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন-
{فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ} [النحل:43]
অর্থঃ তোমরা না জানলে বিজ্ঞদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাও। {সূরা নাহল-৪৩}
বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কিরাম কুরআন সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মাত, এবং যুক্তির নিরিখে সকল সমস্যার সমাধান বের করেছেন। সেই সকল বিজ্ঞদের অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব অনুসরণ।
মাজহাব রাসুল(সা) এর সময় থেকে পরিচিত ছিল কী নাঃ
রাসূল (সা) এর দুনিয়াতে কারো মাযহাব অনুসরণের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তিনি নিজেই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে শরীয়ত প্রণয়ন করেছেন। তিনি কার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অনুসরণ করবেন? তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার থেকেই সমাধান জেনে আমল করেছেন, এবং আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন।তাঁর সময়ে মাজহাব থাকবার প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
তবে সাহাবীদের সময় থেকে এর নিদর্শন পাওয়া যায়।সাহাবায়ে কিরাম যারা সরাসরি রাসূল সাঃ এর কাছে ছিলেন তাদের জন্য রাসূল (সা) এর ব্যাখ্যা অনুসরণ করা ছিল আবশ্যক। এছাড়া কারো ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু যেই সকল সাহাবারা ছিলেন নবীজী (সা) থেকে দূরে তারা সেই স্থানের বিজ্ঞ সাহাবীর মাযহাব তথা মত অনুসরণ করতেন। যেমন ইয়ামেনে হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ এর মত তথা মাযহাবের অনুসরণ হত। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ(রা) কে অনুসরণ করতেন ইরাকের মানুষ।
# রাসূল (সা) যখন মুয়াজ বিন জাবাল (রা) কে ইয়ামানে পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন মুয়াজ (রা) কে জিজ্ঞেস করলেন-“যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হবে তখন তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে?” তখন তিনি বললেন-“আমি ফায়সালা করব কিতাবুল্লাহ দ্বারা”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি কিতাবুল্লাহ এ না পাও?” তিনি বললেন-“তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাত দ্বারা ফায়সালা করব”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাতে না পাও?” তখন তিনি বললেন-“তাহলে আমি ইজতিহাদ করার চেষ্টা করব”। তখন রাসূল সাঃ তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন-“যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট”। {সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৯৪, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৩২৭, সুনানে দারেমী, হাদিস নং-১৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৬১}
এই হাদীসে লক্ষ্য করুন-রাসূল(সা) এর জীবদ্দশায় হযরত মুয়াজ রাঃ বলছেন যে, আমি কুরআন সুন্নাহ এ না পেলে নিজ থেকে ইজতিহাদ করব, আল্লাহর নবী(সা) বললেন-“আল হামদুলিল্লাহ”। এছাড়া সাহাবাদের যুগে যে সকল সাহাবাদের মাযহাব তথা মত অনুসরণীয় ছিল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-
হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা), হযরত আলী বিন আবু তালিব (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত জায়েদ বিন সাবেত (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা) প্রমূখ সাহাবাগণ।
তাবেয়ীরা যেই সকল এলাকায় থাকতেন, সেই সকল এলাকার বিজ্ঞ সাহাবীদের বা বিজ্ঞ মুজতাহিদের মত তথা মাযহাবের অনুসরণ করতেন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-
হযরত সাঈদ বিন মুসায়্যিব (র), হযরত আবু সালমা বিন আব্দির রহমান (র), হযরত ওরওয়া বিন জুবাইর (র) হযরত কাসেম বিন মুহাম্মদ (র), হযরত সুলাইমান বিন ইয়াসার (র), হযরত খারেজা বিন জায়েদ (র) প্রমূখবৃন্দ।
তারপর মদীনায় যাদের মত তথা মাযহাবের অনুসরণ করা হত তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-হযরত ইমাম জুহরী (র), হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ (র), হযরত রাবিয়া বিন আব্দির রহমান (র)।
আর মক্কা মুকার্রমায় ছিলেন আতা বিন আবি রাবাহ (র), আলী বিন আবি তালহা (র), আব্দুল মালিক বিন জুরাইজ (র) প্রমূখ।
আর কুফায় ছিলেন হযরত ইবরাহীম নাখয়ী, আমের বিন শুরাহবীল, শা’বী, আলকামা, আল আসওয়াদ (র)।
আর বসরায় ছিলেন-হাসান বসরী (র)। ইয়ামানে হযরত তাওস বিন কায়সান (র)। শামে হযরত মাকহুল (র) প্রমূখ।
যাদের ফাতওয়া বিধৃত হয়েছে-মুয়াত্তাগুলোতে।, মুসনাদগুলোতে, আর সুনানগুলোতে, যেমন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, কিতাবুল আসার, শরহু মায়ানিল আসার ইত্যাদী গ্রন্থে। {উসুলুল ইফতা লিত তাক্বী উসমানী দাঃবাঃ}
বর্তমানে চারটি মাজহাব সুপরিচিত।এগুলো মুজতাহিদ আলেম আবু হানিফা(র),শাফিঈ(র),মালিক(র) এবং ইবন হাম্বল(র) এর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
মাজহাব বিষয়ে ফাতওয়া আল লাযনাহ এর ৩৩২৩নং ফতোয়ায় যা উল্লেখ করা হয়েছে,তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি।
মাজহাবের মুজতাহিদ ইমামগণ কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে রায় দিতেন।এক্ষেত্রে তাঁরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত দেন,তাহলে তাঁরা ২টি নেকী পাবেন,একটি ইজতিহাদের(গবেষণা)জন্য এবং অন্যটি সঠিক হবার জন্য।আর যদি ভুল সিদ্ধান্ত দেন,তাহলে তাঁরা ইজতিহাদের একটি নেকী পাবেন এবং তাঁদের ভুল ক্ষমা করে দেওয়া হবে।যেসব ইলমসম্পন্ন ব্যক্তিদের কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে রায় আহরণের যোগ্যতা রয়েছে,তাদের জন্য অন্ধভাবে তাকলিদ করা সঙ্গত নয়।তারা নিজেরা ইজতিহাদের মাধ্যমে রায় অনুসরণ করবেন।যাদের এই যোগ্যতা নেই,তারা যে মুজতাহিদের রায় মানতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন,তার রায় মানবেন।যদি তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন,তবে তিনি অনুসন্ধান করবেন যতদিন তিনি অন্য কাউকে না পান যার রায় অনুসরণ করতে তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
আরো বলা হয়েছে,
সুতরাং,তাকে এমন একজনকে জিজ্ঞাসা করার জন্য চেষ্টা করতে হব,যিনি তার নিকট বিশ্বাসযোগ্য এবং তাঁর ইলম,সদগুণ,ধর্মানুগতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতার জন্য সুপরিচিত। (ফাতওয়া আল লাযনাহ আদ দাইমাহ-৫/৫৬)
এটি ধারণা করা ভুল যে চারটি মাজহাবের বাইরে আর কোন মাজহাব হতে পারে না।আমাদের মূল উদ্যেশ্য হচ্ছে শরিয়ত অনুসরণ।সেই উদ্যেশ্যের জন্য আমরা যে কোন মাজহাব অনুসরণ করতে পারি,যে কোন মুজতাহিদ ইমামের রায়কে অনুসরণ করতে পারি।হতে পারেন তিনি আবু হানিফা(র),হতে পারেন তিনি বিন বাজ(র)।যাঁর ইজতিহাদের যোগ্যতা থাকবে তিনি অন্ধ তাকলিদ করবেন না,তিনি ইজতিহাদের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহ থেকে শরিয়ত অনুসরণ করবেন।আর যেসব সাধারণ মানুষের সেই সক্ষমতা থাকবে না,তারা শরিয়ত পালন করবার নিমিত্তে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোন একজন মুজতাহিদের রায়কে অনুসরণ করবেন।তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে,মাজহাব যেন কেউ প্রবৃত্তির অনুসরণের জন্য বা ইচ্ছানুযায়ী ফতোয়া পালনের জন্য না মানে,শুধুমাত্র সহীহ শরিয়ত পালন করবার জন্য মানে।শরিয়ত পালন করা হচ্ছে ফরয।মাজহাব হচ্ছে সেই ফরয পালনের একটি সহায়ক।
আশা করি আপনার উত্তরটি পেয়েছেন।
MRM-1.1
ইসলামে মাজহাব কীঃ
মাজহাব কথাটির অর্থ হচ্ছে চলার পথ।ইজতিহাদের সঙ্গে এর ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায়,কুরআন-সুন্নাহে যেসব বিধান-আহকাম প্রচ্ছন্ন রয়েছে,তা চিন্তা-গবেষনার মাধ্যমে আহরণ করা।যিনি এটি করেন,তাকে বলা হয় মুজতাহিদ।মুজতাহিদ কুরআন-সুন্নাহ থেকে যেসব বিধান-আহকাম আহরণ করেন,সেগুলোই হচ্ছে মাজহাব।অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ থেকে বিধানসমূহ আহরণ করে তার আলোকে মুজতাহিদগণ যেসব মতামত প্রদান করেন,তাকেই মাজহাব বলা হয়।
মাজহাব পালনের কথা এই জন্য বলা হয় যে, যেহেতু কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে মুজতাহিদ আলেমের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অধিকাংশ সাধারণ আলেম কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কী,আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে এই বাক্যটি? এই আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে-ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞ হন না। সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদীস কোনটি দুর্বল হাদীস,কোন হাদীস কি কারণে দুর্বল,কোন হাদীস কী কারণে শক্তিশালী,হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম অত্যন্ত বিরল। অথচ হাদীসের বর্ণনাকারী শক্তিশালী না হলে তার দ্বারা শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয় না।মুজতাহিদ আলেমগণ এসব বিষয় বিবেচনা করে রায় দিতে সক্ষম।সাধারণ আলেমদের সাথে এখানে তাদের বড় পার্থক্য।আহমাদ ইবন হাম্বল(র) মুজতাহিদ ফকীহ হবার জন্য ৫ লক্ষ হাদিস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকার কথা বলেছেন।(সূত্র ইমদাদুল ফাতওয়া ৪/৮৭)
একটি ছোট উদাহরণ পেশ করছি।এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-اقيموا الصلاة
অর্থঃ সালাত কায়েম কর। আরেক আয়াতে বলেছেন-إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেস্তারা নবীজীর উপর সালাত পড়ে। এই আয়াতের শেষাংশে এসেছে
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ হে মুমিনরা তোমরাও তাঁর উপর সালাত পড় এবং তাঁকে সালাম জানাও। {সূরা আহযাব-৫৬}
এই সকল স্থানে লক্ষ্য করুন-“সালাত” শব্দটির দিকে। তিনটি স্থানে সালাত এসেছে। এই তিন স্থানের সালাত শব্দের ৪টি অর্থ। প্রথম অংশে সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল “নামায” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিলেন যে,
তোমরা নামায কায়েম কর। {সূরা বাকারা-৪৩}
আর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও তার ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর উপর সালাত পড়েন মানে হল-আল্লাহ তায়ালা নবীজী সাঃ এর উপর রহমত পাঠান, আর ফেরেস্তারা নবীজী (সা) এর উপর সালাত পড়েন, মানে হল নবীজী সাঃ এর জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।
আর তৃতীয় আয়াতাংশে “সালাত” দ্বারা উদ্দেশ্য হল উম্মতরা যেন নবীজী সাঃ এর উপর দরূদ পাঠ করেন।
(كتاب الكليات ـ لأبى البقاء الكفومى)
এরকম অসংখ্য স্থান আছে, যার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। তাই একজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তির শরাপন্ন হয়ে তার গবেষনা অনুযায়ী উক্ত বিষয়ের সমাধান নেয়াটাই হল যৌক্তিক। এই নির্দেশনাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন-
{فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ} [النحل:43]
অর্থঃ তোমরা না জানলে বিজ্ঞদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাও। {সূরা নাহল-৪৩}
বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কিরাম কুরআন সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মাত, এবং যুক্তির নিরিখে সকল সমস্যার সমাধান বের করেছেন। সেই সকল বিজ্ঞদের অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব অনুসরণ।
মাজহাব রাসুল(সা) এর সময় থেকে পরিচিত ছিল কী নাঃ
রাসূল (সা) এর দুনিয়াতে কারো মাযহাব অনুসরণের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তিনি নিজেই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে শরীয়ত প্রণয়ন করেছেন। তিনি কার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অনুসরণ করবেন? তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার থেকেই সমাধান জেনে আমল করেছেন, এবং আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন।তাঁর সময়ে মাজহাব থাকবার প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
তবে সাহাবীদের সময় থেকে এর নিদর্শন পাওয়া যায়।সাহাবায়ে কিরাম যারা সরাসরি রাসূল সাঃ এর কাছে ছিলেন তাদের জন্য রাসূল (সা) এর ব্যাখ্যা অনুসরণ করা ছিল আবশ্যক। এছাড়া কারো ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু যেই সকল সাহাবারা ছিলেন নবীজী (সা) থেকে দূরে তারা সেই স্থানের বিজ্ঞ সাহাবীর মাযহাব তথা মত অনুসরণ করতেন। যেমন ইয়ামেনে হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ এর মত তথা মাযহাবের অনুসরণ হত। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ(রা) কে অনুসরণ করতেন ইরাকের মানুষ।
# রাসূল (সা) যখন মুয়াজ বিন জাবাল (রা) কে ইয়ামানে পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন মুয়াজ (রা) কে জিজ্ঞেস করলেন-“যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হবে তখন তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে?” তখন তিনি বললেন-“আমি ফায়সালা করব কিতাবুল্লাহ দ্বারা”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি কিতাবুল্লাহ এ না পাও?” তিনি বললেন-“তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সুন্নাত দ্বারা ফায়সালা করব”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাতে না পাও?” তখন তিনি বললেন-“তাহলে আমি ইজতিহাদ করার চেষ্টা করব”। তখন রাসূল সাঃ তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন-“যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট”। {সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৯৪, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৩২৭, সুনানে দারেমী, হাদিস নং-১৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৬১}
এই হাদীসে লক্ষ্য করুন-রাসূল(সা) এর জীবদ্দশায় হযরত মুয়াজ রাঃ বলছেন যে, আমি কুরআন সুন্নাহ এ না পেলে নিজ থেকে ইজতিহাদ করব, আল্লাহর নবী(সা) বললেন-“আল হামদুলিল্লাহ”। এছাড়া সাহাবাদের যুগে যে সকল সাহাবাদের মাযহাব তথা মত অনুসরণীয় ছিল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-
হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা), হযরত আলী বিন আবু তালিব (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত জায়েদ বিন সাবেত (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা), হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা) প্রমূখ সাহাবাগণ।
তাবেয়ীরা যেই সকল এলাকায় থাকতেন, সেই সকল এলাকার বিজ্ঞ সাহাবীদের বা বিজ্ঞ মুজতাহিদের মত তথা মাযহাবের অনুসরণ করতেন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-
হযরত সাঈদ বিন মুসায়্যিব (র), হযরত আবু সালমা বিন আব্দির রহমান (র), হযরত ওরওয়া বিন জুবাইর (র) হযরত কাসেম বিন মুহাম্মদ (র), হযরত সুলাইমান বিন ইয়াসার (র), হযরত খারেজা বিন জায়েদ (র) প্রমূখবৃন্দ।
তারপর মদীনায় যাদের মত তথা মাযহাবের অনুসরণ করা হত তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-হযরত ইমাম জুহরী (র), হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ (র), হযরত রাবিয়া বিন আব্দির রহমান (র)।
আর মক্কা মুকার্রমায় ছিলেন আতা বিন আবি রাবাহ (র), আলী বিন আবি তালহা (র), আব্দুল মালিক বিন জুরাইজ (র) প্রমূখ।
আর কুফায় ছিলেন হযরত ইবরাহীম নাখয়ী, আমের বিন শুরাহবীল, শা’বী, আলকামা, আল আসওয়াদ (র)।
আর বসরায় ছিলেন-হাসান বসরী (র)। ইয়ামানে হযরত তাওস বিন কায়সান (র)। শামে হযরত মাকহুল (র) প্রমূখ।
যাদের ফাতওয়া বিধৃত হয়েছে-মুয়াত্তাগুলোতে।, মুসনাদগুলোতে, আর সুনানগুলোতে, যেমন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, কিতাবুল আসার, শরহু মায়ানিল আসার ইত্যাদী গ্রন্থে। {উসুলুল ইফতা লিত তাক্বী উসমানী দাঃবাঃ}
বর্তমানে চারটি মাজহাব সুপরিচিত।এগুলো মুজতাহিদ আলেম আবু হানিফা(র),শাফিঈ(র),মালিক(র) এবং ইবন হাম্বল(র) এর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
মাজহাব বিষয়ে ফাতওয়া আল লাযনাহ এর ৩৩২৩নং ফতোয়ায় যা উল্লেখ করা হয়েছে,তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি।
মাজহাবের মুজতাহিদ ইমামগণ কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে রায় দিতেন।এক্ষেত্রে তাঁরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত দেন,তাহলে তাঁরা ২টি নেকী পাবেন,একটি ইজতিহাদের(গবেষণা)জন্য এবং অন্যটি সঠিক হবার জন্য।আর যদি ভুল সিদ্ধান্ত দেন,তাহলে তাঁরা ইজতিহাদের একটি নেকী পাবেন এবং তাঁদের ভুল ক্ষমা করে দেওয়া হবে।যেসব ইলমসম্পন্ন ব্যক্তিদের কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে রায় আহরণের যোগ্যতা রয়েছে,তাদের জন্য অন্ধভাবে তাকলিদ করা সঙ্গত নয়।তারা নিজেরা ইজতিহাদের মাধ্যমে রায় অনুসরণ করবেন।যাদের এই যোগ্যতা নেই,তারা যে মুজতাহিদের রায় মানতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন,তার রায় মানবেন।যদি তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন,তবে তিনি অনুসন্ধান করবেন যতদিন তিনি অন্য কাউকে না পান যার রায় অনুসরণ করতে তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
আরো বলা হয়েছে,
সুতরাং,তাকে এমন একজনকে জিজ্ঞাসা করার জন্য চেষ্টা করতে হব,যিনি তার নিকট বিশ্বাসযোগ্য এবং তাঁর ইলম,সদগুণ,ধর্মানুগতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতার জন্য সুপরিচিত। (ফাতওয়া আল লাযনাহ আদ দাইমাহ-৫/৫৬)
এটি ধারণা করা ভুল যে চারটি মাজহাবের বাইরে আর কোন মাজহাব হতে পারে না।আমাদের মূল উদ্যেশ্য হচ্ছে শরিয়ত অনুসরণ।সেই উদ্যেশ্যের জন্য আমরা যে কোন মাজহাব অনুসরণ করতে পারি,যে কোন মুজতাহিদ ইমামের রায়কে অনুসরণ করতে পারি।হতে পারেন তিনি আবু হানিফা(র),হতে পারেন তিনি বিন বাজ(র)।যাঁর ইজতিহাদের যোগ্যতা থাকবে তিনি অন্ধ তাকলিদ করবেন না,তিনি ইজতিহাদের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহ থেকে শরিয়ত অনুসরণ করবেন।আর যেসব সাধারণ মানুষের সেই সক্ষমতা থাকবে না,তারা শরিয়ত পালন করবার নিমিত্তে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোন একজন মুজতাহিদের রায়কে অনুসরণ করবেন।তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে,মাজহাব যেন কেউ প্রবৃত্তির অনুসরণের জন্য বা ইচ্ছানুযায়ী ফতোয়া পালনের জন্য না মানে,শুধুমাত্র সহীহ শরিয়ত পালন করবার জন্য মানে।শরিয়ত পালন করা হচ্ছে ফরয।মাজহাব হচ্ছে সেই ফরয পালনের একটি সহায়ক।
আশা করি আপনার উত্তরটি পেয়েছেন।
MRM-1.1
© 2013 by Ask Islam Bangla.