প্রশ্ন ৫৮ --> যাকাত সম্পর্কে জানতে চাই
উত্তর :
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
যাকাত অর্থ পবিত্রতা বা বৃদ্ধি। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়তের নির্দেশ মুতাবিক এক নির্দিষ্ট (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ ছদকা গ্রহণের উপযোগী কোন মুসলমানের অধিকারে দিয়ে দেয়া। এ স্থলে দাতা গ্রহীতা থেকে বিনিময়স্বরূপ কোন ফায়দা হাছিল করতে পারবে না। কোন সুবিধা হাছিল করলে বা হাছিলের আশা রাখলে তার যাকাত আদায় হবেনা।
যাকাত কার উপর ফরজ :
-যাকাত দাতাকে মুসলমান হতে হবে।
-প্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।
-নিসাব পরিমাণ মাল অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য বা টাকা তার বৎসরের সকল মৌলিক প্রয়োজনের পর অতিরিক্ত থাকতে হবে। (‘নিসাব’ বলা হয় শরীয়তের নির্ধারিত আর্থিক নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে অর্থাৎ যে পরিমাণ সম্পদ-মাল, অর্থ কোন ব্যক্তির সাংসারিক সকল মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর পর বছর শেষে নির্দিষ্ট তারিখে ওই ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে যাকাত প্রদান করতে হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলে। মালের প্রকৃতি ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মালের নিসাব বিভিন্ন। )
-যদি এককভাবে কোন পণ্য বা দ্রব্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ না হয় কিন্তু ব্যক্তির সবগুলো সম্পদের মূল্য মিলিয়ে একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান হয় তবে ওই ব্যক্তির নিসাব পূর্ণ হবে। অর্থাৎ যাকাত আদায় করতে হবে।
-সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণ কর্তনের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে।
-স্বামী-স্ত্রীর সস্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্নহেতু পৃথকভাবে নিজ নিজ সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে।
-নির্ধারিত যাকাত পরিশোধের পূর্বেই সম্পদের মালিক মারা গেলে যাকাত পরিশোধের পর ওয়ারিশগণ মালিক বলে গণ্য হবে।
যাকাত পাবার হকদার কারা :
নিম্নলিখিত আট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা ফরয। পবিত্র কুরআন শরীফ-এ আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
“যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। "(সূরা তওবা : ৬০)
ফকির : ফকির ওই ব্যক্তি যার নিকট খুবই সামান্য সহায় সম্বল আছে।
মিসকীন : মিসকীন ওই ব্যক্তি যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এবং আত্মসম্মানের খাতিরে কারো কাছে হাত পাততে পারে না।
আমিল বা যাকাত আদায় ও বিতরণের কর্মচারী।
মন জয় করার জন্য নওমুসলিম : অন্য ধর্ম ছাড়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। অভাবে তাদের সাহায্য করে ইসলামে সুদৃঢ় করা।
ঋণমুক্তির জন্য : জীবনের মৌলিক বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য সঙ্গতকারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত প্রদান করা যাবে।
দাসমুক্তি : কৃতদাসের মুক্তির জন্য।
ফি সাবিলিল্লাহ বা জিহাদ : অর্থাৎ ইসলামকে বোল-বালা বা বিজয়ী করার লক্ষ্যে যারা কাফির বা বিধর্মীদের সাথে জিহাদে রত সে সকল মুজাহিদদের প্রয়োজনে যাকাত দেয়া যাবে।
মুসাফির : মুসাফির অবস্থায় কোন ব্যক্তি বিশেষ কারণে অভাবগ্রস্থ হলে ওই ব্যক্তির বাড়িতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
কাদের কে যাকাত দেওয়া যাবে না :
উসর বা ফসলের যাকাত:
কৃষিজাত পণ্য-ফল ও ফসলের যাকাতকে ইসলামী পরিভাষায় ‘উশর’ বলে। বাংলাদেশের জমি উশরী কিনা তা নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও হক্কানী আলিম-উলামাগণের মতামত উশর প্রদানের পক্ষে। ইমামে আয’ম হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে কম বেশি যাই হোক উশর আদায় করতে হবে। জমির খাজনা বা কর দিলেও উশর আদায় করতে হবে। বছরে একাধিক ফসল উৎপন্ন হলে প্রতি ফসলেই ‘উশর’ দিতে হবে।
স্বামী- স্ত্রীর সম্পদ বা অলংকারের যাকাত কে দিবে ?
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্ন তাই পৃথকভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যদি অলঙ্কার ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তবে স্ত্রীর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বা কিছু অলঙ্কার বিক্রি করে যাকাত আদায় করতে হবে। অলঙ্কারের যাকাত স্ত্রীর পক্ষে স্বামী আদায় করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
কখন থেকে যাকাত হিসাব করতে হয় :
যাকাত বছরান্তে ফরয এবং বছরান্তে যাকাতের হিসাব করা ওয়াজিব। চন্দ্র বছরের যে কোন একটি তারিখকে যাকাত হিসাবের জন্য নির্ধারিত করতে হবে। বাংলা বা ইংরেজি বছর হিসাব করলে তা শুদ্ধ হবে না। হিসাবের সুবিধার্থে পহেলা রমাদ্বান শরীফ-এ যাকাত হিসাব করা যেতে পারে। মহান আল্লাহ পাক রমাদ্বানের রহমতের কারণে এ সময় সত্তর গুণ বেশি পুণ্য দান করেন। যাকাত যোগ্য সকল সম্পদ পণ্যের বেলায় এই শর্ত আরোপিত কিন্তু কৃষিজাত ফসল, মধু, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বছরান্তের শর্ত নাই। প্রতিটি ফসল তোলার সাথে সাথেই যাকাত আদায় করতে হবে।
অনাদায়ী বা কাযা যাকাত :
যদি কারো অতীত যাকাত অনাদায়ী বা অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা ঋণের মধ্যে গণ্য হবে। চলতি বছরে যাকাত আদায়ের পূর্বেই অনাদায়ী কাযা যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত না দেওয়ার পরিণাম
যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ঈমান ও ছালাতের পরেই যাকাতের স্থান। মহান আল্লাহ পৃথিবীর মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য যাকাত ফরয করেছেন। পবিত্র কুরআনে ৩২ জায়গায় যাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। যাকাত না দিলে সম্পদ শুধু ধনীদের কাছে জমা হয়। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং ধনীরা ও সূদখোররা জোঁকের মত সমাজের রক্ত শোষণ করে নিজে বড় হয়, আর সমাজকে রক্তহীন করে দেয়। তাই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ-
# আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
‘প্রত্যেক সোনা-রূপার মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য বহু পাত তৈরী করা হবে এবং সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পাঁজর কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হবে, তখনই তা গরম করা হবে (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) সেই দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। সকল বান্দার বিচার নিষ্পতি না হওয়া পর্যন্ত তার এ অবস্থা চলতে থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! উট সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, কোন উটের মালিক যে তার হক্ব আদায় করবে না। আর তার হক্ব সমূহের মধ্যে পানি পানের তারিখে তার দুধ দোহন করা এবং অন্যদের দান করাও এক হক্ব। যখন ক্বিয়ামতের দিন আসবে তখন এক প্রশস্ত বিশাল ময়দানে তাকে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল উট যা একটি বাচ্চাকেও হারাবে না- পূর্ণভাবে তাকে ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে ও মুখ দ্বারা কামড়াতে থাকবে। এভাবে যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এরূপ করা হবে এমন দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান, যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ জান্নাতে অথবা জাহান্নামের দিকে দেখতে পাবে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গরু ও ছাগল সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক গরু ও ছাগলের মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করবে না, ক্বিয়ামতের দিনে তাকে এক ধুধু মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল গরু ও ছাগল তাকে শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে ও ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে। অথচ সেদিন তার একটি গরু বা ছাগলও শিং বাঁকা, শিং হীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি গরু-ছাগলকেও সে হারাবে না। যখনই তার প্রথম দল অতিক্রম করবে, তখনই শেষ দল এসে পৌঁছবে। (এরূপ করা হবে) সে দিনে, যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ হয় জান্নাতে, না হয় জাহান্নামে দেখতে পাবে।
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ঘোড়া সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, ঘোড়া তিন প্রকার। ঘোড়া কারো জন্য পাপের কারণ, কারো জন্য আবরণস্বরূপ আর কারো জন্য ছওয়াবের বিষয়। (১) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য পাপের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে লোক দেখানো অহংকার ও মুসলমানদের প্রতি শত্রুতার উদ্দেশ্যে। (২) যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে আবরণ স্বরূপ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে লালন-পালন করেছে আল্লাহর রাস্তায় এবং তার সম্পর্কে ও তার পিঠে আল্লাহর হক্ব সম্পর্কে ভুলেনি। এই ঘোড়া তার মান-সম্মানের জন্য আবরণ স্বরূপ। আর (৩) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য ছওয়াবের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে কোন চারণভূমিতে বা ঘাসের বাগানে শুধু আল্লাহর রাস্তায় মুসলমানদের দেশ রক্ষার জন্য। তখন তার সে ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানের যা কিছু খাবে, সে পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে এবং তার গোবর ও প্রস্রাব পরিমাণও নেকী লেখা হবে। যদি তা আপন রশি ছিড়ে একটি অথবা দু’টি মাঠও বিচরণ করে তাহ’লে তার পদচিহ্ন ও গোবর পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে। এছাড়া তার মালিক যদি তাকে কোন নদীর কিনারে নিয়ে যায়, আর সেটা নদী হ’তে পানি পান করে, অথচ মালিকের ইচ্ছা ছিল না তাকে পানি পান করানোর। তবুও ঐ পানি পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গাধা সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, গাধার বিষয়ে আমার নিকট শুধু এই স্বতন্ত্র ও ব্যাপকার্থক আয়াতটি নাযিল হয়েছে ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সেদিন সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে’
(যিলযাল ৯৯/৭-৮; মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭৩; বাংলা মিশকাত হা/১৬৮১)
আল্লাহর দেয়া সম্পদের যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ পার্থিব জীবনে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে, তেমনি পরকালীন জীবনে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতের অফুরন্ত সুখ লাভে ধন্য হবে। তাই আমাদের সকলের উচিত সোনা-রূপা ও গবাদি পশুসহ সকল সম্পদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করা এবং মহান আল্লাহ নির্দেশিত পথে খরচ করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
LTA-47.186
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
যাকাত অর্থ পবিত্রতা বা বৃদ্ধি। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়তের নির্দেশ মুতাবিক এক নির্দিষ্ট (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ ছদকা গ্রহণের উপযোগী কোন মুসলমানের অধিকারে দিয়ে দেয়া। এ স্থলে দাতা গ্রহীতা থেকে বিনিময়স্বরূপ কোন ফায়দা হাছিল করতে পারবে না। কোন সুবিধা হাছিল করলে বা হাছিলের আশা রাখলে তার যাকাত আদায় হবেনা।
যাকাত কার উপর ফরজ :
-যাকাত দাতাকে মুসলমান হতে হবে।
-প্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।
-নিসাব পরিমাণ মাল অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য বা টাকা তার বৎসরের সকল মৌলিক প্রয়োজনের পর অতিরিক্ত থাকতে হবে। (‘নিসাব’ বলা হয় শরীয়তের নির্ধারিত আর্থিক নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে অর্থাৎ যে পরিমাণ সম্পদ-মাল, অর্থ কোন ব্যক্তির সাংসারিক সকল মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর পর বছর শেষে নির্দিষ্ট তারিখে ওই ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে যাকাত প্রদান করতে হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলে। মালের প্রকৃতি ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মালের নিসাব বিভিন্ন। )
-যদি এককভাবে কোন পণ্য বা দ্রব্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ না হয় কিন্তু ব্যক্তির সবগুলো সম্পদের মূল্য মিলিয়ে একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান হয় তবে ওই ব্যক্তির নিসাব পূর্ণ হবে। অর্থাৎ যাকাত আদায় করতে হবে।
-সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণ কর্তনের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে।
-স্বামী-স্ত্রীর সস্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্নহেতু পৃথকভাবে নিজ নিজ সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে।
-নির্ধারিত যাকাত পরিশোধের পূর্বেই সম্পদের মালিক মারা গেলে যাকাত পরিশোধের পর ওয়ারিশগণ মালিক বলে গণ্য হবে।
যাকাত পাবার হকদার কারা :
নিম্নলিখিত আট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা ফরয। পবিত্র কুরআন শরীফ-এ আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
“যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। "(সূরা তওবা : ৬০)
ফকির : ফকির ওই ব্যক্তি যার নিকট খুবই সামান্য সহায় সম্বল আছে।
মিসকীন : মিসকীন ওই ব্যক্তি যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এবং আত্মসম্মানের খাতিরে কারো কাছে হাত পাততে পারে না।
আমিল বা যাকাত আদায় ও বিতরণের কর্মচারী।
মন জয় করার জন্য নওমুসলিম : অন্য ধর্ম ছাড়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। অভাবে তাদের সাহায্য করে ইসলামে সুদৃঢ় করা।
ঋণমুক্তির জন্য : জীবনের মৌলিক বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য সঙ্গতকারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত প্রদান করা যাবে।
দাসমুক্তি : কৃতদাসের মুক্তির জন্য।
ফি সাবিলিল্লাহ বা জিহাদ : অর্থাৎ ইসলামকে বোল-বালা বা বিজয়ী করার লক্ষ্যে যারা কাফির বা বিধর্মীদের সাথে জিহাদে রত সে সকল মুজাহিদদের প্রয়োজনে যাকাত দেয়া যাবে।
মুসাফির : মুসাফির অবস্থায় কোন ব্যক্তি বিশেষ কারণে অভাবগ্রস্থ হলে ওই ব্যক্তির বাড়িতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
কাদের কে যাকাত দেওয়া যাবে না :
- উলামায়ে ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা দ্বারা পরিচালিত মাদরাসা অর্থাৎ যারা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য কুফরী মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত সেই সমস্ত মাদরাসাতে যাকাত প্রদান করলে যাকাত আদায় হবে না।
- নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবে না।
- মুতাক্বাদ্দিমীন অর্থাৎ পূর্ববর্তী আলিমগণের মতে কুরাঈশ গোত্রের বনু হাশিম-এর অন্তর্গত আব্বাস, জাফর, আকীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের বংশধরের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। তবে মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পরবর্তী আলিমগণের মতে বৈধ।
- অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
- যে সমস্ত মাদরাসায় ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোডিং আছে সেখানে যাকাত দেয়া যাবে এবং যে সমস্ত মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং নেই সেখানে যাকাত দেয়া যাবে না।
- দরিদ্র পিতামাতাকে, সন্তানকে, স্ত্রীকে যাকাত দেয়া যাবে না।
- প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইয়াতীমখানা লিল্লাহ বোডিংয়ের জন্য যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত হলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না।
- উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায় তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে সে যদি উপার্জন না থাকার কারণে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে যাকাত দেয়া যাবে।
- বেতন বা ভাতা হিসেবে নিজ চাকর-চাকরানীকে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে না।
উসর বা ফসলের যাকাত:
কৃষিজাত পণ্য-ফল ও ফসলের যাকাতকে ইসলামী পরিভাষায় ‘উশর’ বলে। বাংলাদেশের জমি উশরী কিনা তা নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও হক্কানী আলিম-উলামাগণের মতামত উশর প্রদানের পক্ষে। ইমামে আয’ম হযরত আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে কম বেশি যাই হোক উশর আদায় করতে হবে। জমির খাজনা বা কর দিলেও উশর আদায় করতে হবে। বছরে একাধিক ফসল উৎপন্ন হলে প্রতি ফসলেই ‘উশর’ দিতে হবে।
স্বামী- স্ত্রীর সম্পদ বা অলংকারের যাকাত কে দিবে ?
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্ন তাই পৃথকভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যদি অলঙ্কার ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তবে স্ত্রীর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বা কিছু অলঙ্কার বিক্রি করে যাকাত আদায় করতে হবে। অলঙ্কারের যাকাত স্ত্রীর পক্ষে স্বামী আদায় করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
কখন থেকে যাকাত হিসাব করতে হয় :
যাকাত বছরান্তে ফরয এবং বছরান্তে যাকাতের হিসাব করা ওয়াজিব। চন্দ্র বছরের যে কোন একটি তারিখকে যাকাত হিসাবের জন্য নির্ধারিত করতে হবে। বাংলা বা ইংরেজি বছর হিসাব করলে তা শুদ্ধ হবে না। হিসাবের সুবিধার্থে পহেলা রমাদ্বান শরীফ-এ যাকাত হিসাব করা যেতে পারে। মহান আল্লাহ পাক রমাদ্বানের রহমতের কারণে এ সময় সত্তর গুণ বেশি পুণ্য দান করেন। যাকাত যোগ্য সকল সম্পদ পণ্যের বেলায় এই শর্ত আরোপিত কিন্তু কৃষিজাত ফসল, মধু, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বছরান্তের শর্ত নাই। প্রতিটি ফসল তোলার সাথে সাথেই যাকাত আদায় করতে হবে।
অনাদায়ী বা কাযা যাকাত :
যদি কারো অতীত যাকাত অনাদায়ী বা অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা ঋণের মধ্যে গণ্য হবে। চলতি বছরে যাকাত আদায়ের পূর্বেই অনাদায়ী কাযা যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত না দেওয়ার পরিণাম
যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ঈমান ও ছালাতের পরেই যাকাতের স্থান। মহান আল্লাহ পৃথিবীর মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য যাকাত ফরয করেছেন। পবিত্র কুরআনে ৩২ জায়গায় যাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। যাকাত না দিলে সম্পদ শুধু ধনীদের কাছে জমা হয়। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং ধনীরা ও সূদখোররা জোঁকের মত সমাজের রক্ত শোষণ করে নিজে বড় হয়, আর সমাজকে রক্তহীন করে দেয়। তাই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ-
# আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
‘প্রত্যেক সোনা-রূপার মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য বহু পাত তৈরী করা হবে এবং সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পাঁজর কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হবে, তখনই তা গরম করা হবে (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) সেই দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। সকল বান্দার বিচার নিষ্পতি না হওয়া পর্যন্ত তার এ অবস্থা চলতে থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! উট সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, কোন উটের মালিক যে তার হক্ব আদায় করবে না। আর তার হক্ব সমূহের মধ্যে পানি পানের তারিখে তার দুধ দোহন করা এবং অন্যদের দান করাও এক হক্ব। যখন ক্বিয়ামতের দিন আসবে তখন এক প্রশস্ত বিশাল ময়দানে তাকে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল উট যা একটি বাচ্চাকেও হারাবে না- পূর্ণভাবে তাকে ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে ও মুখ দ্বারা কামড়াতে থাকবে। এভাবে যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এরূপ করা হবে এমন দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান, যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ জান্নাতে অথবা জাহান্নামের দিকে দেখতে পাবে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গরু ও ছাগল সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক গরু ও ছাগলের মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করবে না, ক্বিয়ামতের দিনে তাকে এক ধুধু মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল গরু ও ছাগল তাকে শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে ও ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে। অথচ সেদিন তার একটি গরু বা ছাগলও শিং বাঁকা, শিং হীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি গরু-ছাগলকেও সে হারাবে না। যখনই তার প্রথম দল অতিক্রম করবে, তখনই শেষ দল এসে পৌঁছবে। (এরূপ করা হবে) সে দিনে, যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ হয় জান্নাতে, না হয় জাহান্নামে দেখতে পাবে।
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ঘোড়া সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, ঘোড়া তিন প্রকার। ঘোড়া কারো জন্য পাপের কারণ, কারো জন্য আবরণস্বরূপ আর কারো জন্য ছওয়াবের বিষয়। (১) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য পাপের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে লোক দেখানো অহংকার ও মুসলমানদের প্রতি শত্রুতার উদ্দেশ্যে। (২) যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে আবরণ স্বরূপ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে লালন-পালন করেছে আল্লাহর রাস্তায় এবং তার সম্পর্কে ও তার পিঠে আল্লাহর হক্ব সম্পর্কে ভুলেনি। এই ঘোড়া তার মান-সম্মানের জন্য আবরণ স্বরূপ। আর (৩) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য ছওয়াবের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে কোন চারণভূমিতে বা ঘাসের বাগানে শুধু আল্লাহর রাস্তায় মুসলমানদের দেশ রক্ষার জন্য। তখন তার সে ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানের যা কিছু খাবে, সে পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে এবং তার গোবর ও প্রস্রাব পরিমাণও নেকী লেখা হবে। যদি তা আপন রশি ছিড়ে একটি অথবা দু’টি মাঠও বিচরণ করে তাহ’লে তার পদচিহ্ন ও গোবর পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে। এছাড়া তার মালিক যদি তাকে কোন নদীর কিনারে নিয়ে যায়, আর সেটা নদী হ’তে পানি পান করে, অথচ মালিকের ইচ্ছা ছিল না তাকে পানি পান করানোর। তবুও ঐ পানি পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গাধা সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন, গাধার বিষয়ে আমার নিকট শুধু এই স্বতন্ত্র ও ব্যাপকার্থক আয়াতটি নাযিল হয়েছে ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সেদিন সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে’
(যিলযাল ৯৯/৭-৮; মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭৩; বাংলা মিশকাত হা/১৬৮১)
আল্লাহর দেয়া সম্পদের যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ পার্থিব জীবনে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে, তেমনি পরকালীন জীবনে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতের অফুরন্ত সুখ লাভে ধন্য হবে। তাই আমাদের সকলের উচিত সোনা-রূপা ও গবাদি পশুসহ সকল সম্পদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করা এবং মহান আল্লাহ নির্দেশিত পথে খরচ করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
LTA-47.186
© 2015 by Ask Islam Bangla.