প্রশ্ন ৩৬ --> কুরবানীর নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই ?
উত্তর :
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা ওয়াজিব।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে,
# ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫)
ইবাদতের মূলকথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা।
কার উপর কুরবানী ওয়াজিব
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
নেসাবের মেয়াদ:
কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)
কুরবানীর সময়:
মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। (মুয়াত্তা মালেক ১৮৮)
চুল-নখ না কাটা :
# উম্মে সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তেত কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’। (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৯; নাসাঈ, মির‘আত হা/১৪৭৪-এর ব্যাখ্যা, ৫/৮৬।)
কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানীর নিয়তে উহা করলে উহাই আল্লাহর নিকটে পূর্ণাঙ্গ কুরবানী হিসাবে গৃহীত হবে। (আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৭৯ ‘আতীরাহ’ অনুচ্ছেদ; হাকেম (বৈরুতঃ তাবি), ৪/২২৩।)
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে:
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
কুরবানীর পশুর বয়সসীমা
উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)
কুরবানীতে শরীক/অংশীদার:
এক পশুতে শরীকের সংখ্যা:
একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)
সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
কোনো অংশীদারের গলদ নিয়ত হলে:
যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯)
কুরবানী করার পদ্ধতি :
উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়। (সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ প্রভৃতি।)
কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ।)
যবহকালীন দো‘আ :
জবাইয়ের অস্ত্র:
ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)
জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)
অন্য পশুর সামনে জবাই করা:
এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট না দেওয়া।
গোশত বন্টন:
শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১)
কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০)
কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। (আল-মুগনী ১১/১০৮; মির‘আত ২/৩৬৯)
কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১)
জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
চামড়া:
কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা শরী‘আত নির্দেশিত ছাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (আদ্দুররুল মুখতার, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, আহমাদ, মির‘আত ৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃঃ।)
আল্লাহ আমাদের সঠিক ভাবে কুরবানী করার তৌফিক দান করুন ।
আমিন ।
আরও পড়ুন
আল কাউসার
আত তাহরিক
STA-27.52
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা ওয়াজিব।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে,
# ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫)
ইবাদতের মূলকথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা।
কার উপর কুরবানী ওয়াজিব
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
নেসাবের মেয়াদ:
কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)
কুরবানীর সময়:
মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। (মুয়াত্তা মালেক ১৮৮)
চুল-নখ না কাটা :
# উম্মে সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তেত কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’। (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৫৯; নাসাঈ, মির‘আত হা/১৪৭৪-এর ব্যাখ্যা, ৫/৮৬।)
কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানীর নিয়তে উহা করলে উহাই আল্লাহর নিকটে পূর্ণাঙ্গ কুরবানী হিসাবে গৃহীত হবে। (আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৭৯ ‘আতীরাহ’ অনুচ্ছেদ; হাকেম (বৈরুতঃ তাবি), ৪/২২৩।)
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে:
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
কুরবানীর পশুর বয়সসীমা
উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)
কুরবানীতে শরীক/অংশীদার:
এক পশুতে শরীকের সংখ্যা:
একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)
সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
কোনো অংশীদারের গলদ নিয়ত হলে:
যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯)
কুরবানী করার পদ্ধতি :
উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে ‘বিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়। (সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মির‘আত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ প্রভৃতি।)
কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃঃ।)
যবহকালীন দো‘আ :
- বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার (অর্থঃ আল্লাহর নামে, আল্লাহ মহান)
- বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী (আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হ’তে)।
এখানে কুরবানী অন্যের হ’লে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন ‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন ফুলান ওয়া মিন আহলে বায়তিহী’ (...অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ হ’তে)। এই সময় নবীর উপরে দরূদ পাঠ করা মাকরূহ’।[মির‘আত ২/৩৫০ পৃঃ; ঐ, ৫/৭৪ পৃঃ।] - ‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী কামা তাক্বাববালতা মিন ইবরাহীমা খালীলিকা’ (...হে আল্লাহ! তুমি আমার পক্ষ হ’তে কবুল কর যেমন কবুল করেছ তোমার দোস্ত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে)।(মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ)
- যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। (ইবনু কুদামা, আল-মুগনী)
- উপরোক্ত দো‘আগুলির সাথে অন্য দো‘আও রয়েছে। যেমন ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা ‘আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লা-হি রবিবল ‘আলামীন। লা শারীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা; (মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী) বিসমিল্লা-হি আল্লাহু আকবার’। (বায়হাক্বী ৯/২৮৭; আবু ইয়া‘লা, মির‘আত ৫/৯২; সনদ হাসান, ইরওয়া ৪/৩৫১)
জবাইয়ের অস্ত্র:
ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)
জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)
অন্য পশুর সামনে জবাই করা:
এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট না দেওয়া।
গোশত বন্টন:
শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১)
কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০)
কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। (আল-মুগনী ১১/১০৮; মির‘আত ২/৩৬৯)
কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১)
জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
চামড়া:
কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা শরী‘আত নির্দেশিত ছাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (আদ্দুররুল মুখতার, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, আহমাদ, মির‘আত ৫/১২১; আল-মুগনী ১১/১১১ পৃঃ।)
আল্লাহ আমাদের সঠিক ভাবে কুরবানী করার তৌফিক দান করুন ।
আমিন ।
আরও পড়ুন
আল কাউসার
আত তাহরিক
STA-27.52
© 2013 by Ask Islam Bangla.