প্রশ্ন ১৮ --> তারাবীহর নামায কি? এ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাই।
উত্তর :
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
► তারাবীহর নামাযঃ
রমাযান মাসের “কিয়ামুল লাইল” বা রাতের কিয়ামকে সালাতুত তারাবীহ বা তারাবীহর নামায বলা হয়।
আরবি শব্দ “কিয়াম”-এর অর্থ দাঁড়িয়ে থাকা। ইসলামী শরিয়তে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকাটাকেই কিয়াম বলে অভিহিত করা হয়।
আর "তারাবীহ” মানে হল আরাম করা। সলফে সালেহীনগণ ৪ রাকআত নামায পড়ে বিরতির সাথে বসে একটু আরাম করতেন,তাই এ নামাযের নামকরণ করা হয়েছে “তারাবীহর নামায”।
► তারাবীহ নামাযের গুরুত্বঃ
তারাবীহর নামায নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ।
# বহু হাদীসগ্রন্থে আবু হুরাইরাহ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,"আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামে রমাযানের ব্যাপারে (সকলকে) উৎসাহিত করতেন;কিন্ত তিনি বাধ্যতামূলকভাবে আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন,'যে ব্যক্তি ঈমান রেখে সওয়াবের আশায় রমাযানের কিয়াম করবে,সে ব্যক্তির পূর্বকৃত সকল পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে।'” (আহমাদ,মুসনাদ ২/২৮১,৫২৯,বুখারী ১৯০১,মুসলিম ৭৫৯,সহীহ আবূ দাউদ ১২২২,সহীহ তিরমিযী,আলবানী ৬৪৮নং)
► তারাবীহ নামাযের প্রচলনঃ
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,"একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নামায পড়লেন। তার অনুসরণ (ইক্তিদা) করে অনেক লোক নামায পড়ল। অতঃপর পরের রাতে নামায পড়লে আরো বেশি লোক হল। তৃতীয় রাতে লোকেরা জমায়েত হলে তিনি বাসা থেকে বের হলেন না। ফজরের সময় তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,'আমি তোমাদের আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। তোমাদের নিকট (নামাযের জন্য) বের হতে আমার কোন বাধা ছিল না। কিন্ত আমি আশঙ্কা করলাম যে,ঐ নামায তোমাদের জন্য ফরয করে দেওয়া হবে।' আর এ ঘটনা হল রমাযানের।" (বুখারী ২০১২,মুসলিম ৭৬১নং)
এভাবেই তারাবীহর নামায প্রচলিত হয়।
► তারাবীহ নামাযের রাকআত সংখ্যাঃ
এবারে আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে,যে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ দ্বিধাবিভক্ত। তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা আসলে কত।
১) আসুন প্রথমে দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত রাকআত তারাবীহর নামায পড়েছেন।
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর না (অর্থ্যাৎ সেই নামায অত্যন্ত সুন্দর ও দীর্ঘ হত)। অতঃপর তিনি ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর না। অতঃপর তিনি ৩ রাকআত বিতর পড়তেন।” (বুখারী ১১৪৭,মুসলিম ৭৩৮নং)
এই হাদীসের মানে হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে ২ রাকআত ২ রাকআত করে প্রথমে ৪ রাকআত একটানা পড়তেন,প্রথম ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে সাথে সাথেই উঠে ২ রাকআত পড়তেন। এরপর বসে বিরতি নিতেন। তারপর আবার ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে সাথে সাথেই উঠে ২ রাকআত পড়তেন। তারপর আবার একটু বসে জিড়িয়ে নিয়ে ৩ রাকআত বিতর পড়ে নামায শেষ করতেন।
অর্থ্যাৎ,মোট রাকআত সংখ্যা দাঁড়ায়,৪+৪+৩ = ১১ রাকআত।
এখন যে প্রশ্নটা আসে,এই নিয়মেই কি তিনি রমাযানেও নামায পড়তেন?
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,রমাযানের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত রাকআত নামায পড়তেন? উত্তরে তিনি বললেন,”তিনি রমাযানে এবং অন্যান্য মাসেও ১১ রাকআত অপেক্ষা বেশি নামায পড়তেন না।” (বুখারী ১১৪৭,মুসলিম ৭৩৮নং)
অতএব,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা ছিল ১১।
অবশ্য হাদীসে এও পাওয়া যায়,তিনি কখনো কখনো ১৩ রাকআত নামায পড়তেন,১০ রাকআত তারাবীহ এবং ৩ রাকআত বিতর।
[প্রথম থেকে শুরু করে আলোচনার এ অংশটুকুর রেফারেন্সঃ “রমাযানের ফাযায়েল এবং রোযার মাসায়েল”,আবদুল হামীদ ফাইযী,তাওহীদ পাবলিকেশন্স]
২) তাহলে এবার প্রশ্ন আসে,২০ রাকআত তারাবীহর প্রচলন হল কীভাবে?
# সাঈব ইবনে ইয়াজিদ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,”উমার রাযিআল্লাহু আনহু রমাযানের রাতে লোকেদের একত্রিত করলেন। এরপর উবাই ইবনে কা'ব এবং তামিম আল-দারীকে ইমাম করে ২১ রাকআত নামায পড়লেন। নামাযে তাঁরা প্রায় একশর মত আয়াত তিলাওয়াত করতেন,এবং ভোর হওয়ার আগে তাঁরা নামায শেষ করতেন।
বেশ অনেকেই এই হাদীসটি আল-সাঈব থেকে বর্ণনা করেছেন,তার মধ্যে কেউ ২০ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন,আবার কেউ ২১ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন,আবার কেউ ২৩ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন।
এর প্রত্যেকটিই সহীহ।
অতএব,আমরা বুঝতে পারি,উমার রাযিআল্লাহু আনহুর আমলে ২০ রাকআত করে জামাআতে তারাবীহর নামায পড়া হত,এবং বাকী রাকআতগুলো ছিল বিতরের নামাযের।
প্রশ্ন হল,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহর নামায পড়তেন ১১ রাকআত,আর উমার রাযিআল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফতকালে চালু করলেন ২০ রাকআত!
☛ কেন?
এর উত্তর দিয়েছেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ।
তিনি বলেন,”যখন উবাই ইবনে কা'ব একটি জামাআতে লোকেদের নিয়ে নামায পড়তেন,তখন লোকেরা এত লম্বা সময় টানা দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না। যার ফলে তিনি রাকআত সংখ্যা বাড়িয়ে দেন (যাতে প্রতি রাকআতে কম সংখ্যক আয়াত তিলাওয়াত করা যায় এবং লোকেদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নামায পড়াটাও সহজ হয়)। প্রথমে তাঁরা ১১ বা ১৩ রাকআত নামাযই পড়তেন,কিন্ত লোকেদের জন্য এত লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ার কারণে তাঁরা তিনি রাকআত সংখ্যা বাড়িয়ে দেন।” [মাজমু আল-ফাতওয়া,২৩/১১৩]
রেফারেন্সঃ Islam QA
☛ তাহলে কি উমার রাযিআল্লাহু আনহু সুন্নাতের খেলাফ করলেন,অর্থ্যাৎ বিদআতের প্রচলন করলেন?
এর উত্তর হল,না।
কারণ হচ্ছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই নিজে ১১ বা ১৩ রাকআত নামায পড়তেন,কিন্ত তিনি কোথাও কিয়ামুল লাইলের রাকআত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলে যান নি।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ যেমন বলেন,”যদি কেউ মনে করে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন,আর সে তার থেকে বাড়াতে বা কমাতে পারবে না,তাহলে তার এই ধারণা ভুল।”
আর উমার রাযিআল্লাহু আনহুর মর্যাদা আমরা সবাই বেশ ভালভাবেই জানি। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম প্রিয় একজন সাহাবী,দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন,মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় খলিফা। যাঁকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন,”শয়তানও তোমাকে ভয় পায় হে উমার।” (আহমাদ,তিরমিযী,সিলসিলাহ সহীহাহ ১৬০৯নং)
অতএব,তিনি ইসলামে বিদআত চালু করবেন,এটা চিন্তা করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রেফারেন্সঃ Islam Web
► কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তরঃ
১) দেখতে পাচ্ছি তারাবীহর নামাযের নির্দিষ্ট কোন রাকআত সংখ্যা নেই। তাহলে আমি কত রাকআত নামায পড়ব?
উত্তরঃ
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন,
“এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে নামাযীর উপর নির্ভর করবে। সে যদি মনে করে,সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম,তাহলে তার জন্য ভাল হবে যদি সে (লম্বা সময় ধরে) ১০ রাকআত তারাবীহ পড়ে এবং ৩ রাকআত বিতর পড়ে,কারণ এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত। কিন্ত সে যদি মনে করে সে বেশিক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম নয়,তাহলে সে (ছোট ছোট করে) ২০ রাকআতও তারাবীহ পড়তে পারে,কারণ এটা মুসলিমদের মাঝে বেশ ভালভাবেই প্রচলিত। এ ব্যাপারে কোন সংখ্যাই অপছন্দনীয় নয়,আর এটা ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহসহ আমাদের বহু ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি।”
রেফারেন্সঃ Islam Web
অতএব,আপনি নিজে যা ভাল মনে করেন, সেভাবেই তারাবীহর নামায পড়ুন। ৮ রাকআত চাইলে ৮ রাকআত পড়ুন,১০ রাকআত চাইলে ১০ রাকআত পড়ুন,২০ রাকআত চাইলে ২০ রাকআত পড়ুন। এ ব্যাপারে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে রাকআত কম পড়লে অবশ্যই দীর্ঘ কিরআতে পড়া উত্তম । আর কিরআত দীর্ঘ করে পড়তে অক্ষম হলে ছোট ছোট ২০ রাকআত আমাদের দেশের মত পড়াই উত্তম ।
২) আমি ৮ রাকআত তারাবীহর পক্ষে,কিন্ত আমাদের এলাকার ইমাম ২০ রাকআত তারাবীহ পড়ান। আমি যদি ৮ রাকআত পড়ে জামাআত ছেড়ে দেই,তাহলে কি আমি পূর্ণ সওয়াব পাব?
উত্তরঃ
# রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
”যে ব্যক্তি ইমামের সাথে নামায পড়ে এবং তার নামায শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে থাকে (ইক্তিদা করে),সেই ব্যক্তির জন্য সারা রাত্রি কিয়াম করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়।” (আহমাদ,মুসনাদ,সহীহ আবূ দাউদ ১২২৭,সহীহ তিরমিযী,আলবানী ৬৪৬,সহীহ নাসাঈ,আলবানী ১৫১৮,সহীহ ইবনে মাজাহ,আলবানী ১৩২৭ নং)
অতএব,আপনার ইমাম যত রাকআত নামায পড়ান,হোক তা বিতরসহ ১১ রাকাআত বা ২৩ রাকআত,আপনি যদি পূর্ণ সওয়াব পেতে চান,আপনাকে ইমামের সাথে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নামায পড়তে হবে। না হলে পূর্ণ সওয়াব পাবেন না।
রেফারেন্সঃ “রমাযানের ফাযায়েল এবং রোযার মাসায়েল”,আবদুল হামীদ ফাইযী,তাওহীদ পাবলিকেশন্স
৩) তারাবীহর দুই রাকআত আর চার রাকআত শেষে বিশেষ দুইটি দুআ পড়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাই।
উত্তরঃ
এ রকম কোন দুআর ব্যাপারে হাদীস থেকে জানা যায় না। তবে মাঝে মাঝে এ দুআগুলো চাইলে পড়তে পারেন, কারণ এই দুআগুলোর অর্থ ঠিক আছে। তবে, এই দুআকে বাধ্যতামূলক মনে করে নিয়মিত পড়া অবশ্যই বিদআত বলে গণ্য হবে।
রেফারেন্সঃ Islam Web
যতদূর সম্ভব তারাবীহর নামাযের বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও যদি আরো কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে আমাদের ওয়ালে প্রশ্ন পোস্ট করুন। ইনশাআল্লাহ আমরা জবাব দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
EDS-1.7
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। দরুদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল (সা) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
► তারাবীহর নামাযঃ
রমাযান মাসের “কিয়ামুল লাইল” বা রাতের কিয়ামকে সালাতুত তারাবীহ বা তারাবীহর নামায বলা হয়।
আরবি শব্দ “কিয়াম”-এর অর্থ দাঁড়িয়ে থাকা। ইসলামী শরিয়তে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকাটাকেই কিয়াম বলে অভিহিত করা হয়।
আর "তারাবীহ” মানে হল আরাম করা। সলফে সালেহীনগণ ৪ রাকআত নামায পড়ে বিরতির সাথে বসে একটু আরাম করতেন,তাই এ নামাযের নামকরণ করা হয়েছে “তারাবীহর নামায”।
► তারাবীহ নামাযের গুরুত্বঃ
তারাবীহর নামায নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ।
# বহু হাদীসগ্রন্থে আবু হুরাইরাহ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,"আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামে রমাযানের ব্যাপারে (সকলকে) উৎসাহিত করতেন;কিন্ত তিনি বাধ্যতামূলকভাবে আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন,'যে ব্যক্তি ঈমান রেখে সওয়াবের আশায় রমাযানের কিয়াম করবে,সে ব্যক্তির পূর্বকৃত সকল পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে।'” (আহমাদ,মুসনাদ ২/২৮১,৫২৯,বুখারী ১৯০১,মুসলিম ৭৫৯,সহীহ আবূ দাউদ ১২২২,সহীহ তিরমিযী,আলবানী ৬৪৮নং)
► তারাবীহ নামাযের প্রচলনঃ
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,"একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নামায পড়লেন। তার অনুসরণ (ইক্তিদা) করে অনেক লোক নামায পড়ল। অতঃপর পরের রাতে নামায পড়লে আরো বেশি লোক হল। তৃতীয় রাতে লোকেরা জমায়েত হলে তিনি বাসা থেকে বের হলেন না। ফজরের সময় তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,'আমি তোমাদের আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। তোমাদের নিকট (নামাযের জন্য) বের হতে আমার কোন বাধা ছিল না। কিন্ত আমি আশঙ্কা করলাম যে,ঐ নামায তোমাদের জন্য ফরয করে দেওয়া হবে।' আর এ ঘটনা হল রমাযানের।" (বুখারী ২০১২,মুসলিম ৭৬১নং)
এভাবেই তারাবীহর নামায প্রচলিত হয়।
► তারাবীহ নামাযের রাকআত সংখ্যাঃ
এবারে আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে,যে ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ দ্বিধাবিভক্ত। তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা আসলে কত।
১) আসুন প্রথমে দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত রাকআত তারাবীহর নামায পড়েছেন।
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন,"রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর না (অর্থ্যাৎ সেই নামায অত্যন্ত সুন্দর ও দীর্ঘ হত)। অতঃপর তিনি ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর না। অতঃপর তিনি ৩ রাকআত বিতর পড়তেন।” (বুখারী ১১৪৭,মুসলিম ৭৩৮নং)
এই হাদীসের মানে হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে ২ রাকআত ২ রাকআত করে প্রথমে ৪ রাকআত একটানা পড়তেন,প্রথম ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে সাথে সাথেই উঠে ২ রাকআত পড়তেন। এরপর বসে বিরতি নিতেন। তারপর আবার ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে সাথে সাথেই উঠে ২ রাকআত পড়তেন। তারপর আবার একটু বসে জিড়িয়ে নিয়ে ৩ রাকআত বিতর পড়ে নামায শেষ করতেন।
অর্থ্যাৎ,মোট রাকআত সংখ্যা দাঁড়ায়,৪+৪+৩ = ১১ রাকআত।
এখন যে প্রশ্নটা আসে,এই নিয়মেই কি তিনি রমাযানেও নামায পড়তেন?
# আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,রমাযানের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত রাকআত নামায পড়তেন? উত্তরে তিনি বললেন,”তিনি রমাযানে এবং অন্যান্য মাসেও ১১ রাকআত অপেক্ষা বেশি নামায পড়তেন না।” (বুখারী ১১৪৭,মুসলিম ৭৩৮নং)
অতএব,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা ছিল ১১।
অবশ্য হাদীসে এও পাওয়া যায়,তিনি কখনো কখনো ১৩ রাকআত নামায পড়তেন,১০ রাকআত তারাবীহ এবং ৩ রাকআত বিতর।
[প্রথম থেকে শুরু করে আলোচনার এ অংশটুকুর রেফারেন্সঃ “রমাযানের ফাযায়েল এবং রোযার মাসায়েল”,আবদুল হামীদ ফাইযী,তাওহীদ পাবলিকেশন্স]
২) তাহলে এবার প্রশ্ন আসে,২০ রাকআত তারাবীহর প্রচলন হল কীভাবে?
# সাঈব ইবনে ইয়াজিদ রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,”উমার রাযিআল্লাহু আনহু রমাযানের রাতে লোকেদের একত্রিত করলেন। এরপর উবাই ইবনে কা'ব এবং তামিম আল-দারীকে ইমাম করে ২১ রাকআত নামায পড়লেন। নামাযে তাঁরা প্রায় একশর মত আয়াত তিলাওয়াত করতেন,এবং ভোর হওয়ার আগে তাঁরা নামায শেষ করতেন।
বেশ অনেকেই এই হাদীসটি আল-সাঈব থেকে বর্ণনা করেছেন,তার মধ্যে কেউ ২০ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন,আবার কেউ ২১ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন,আবার কেউ ২৩ রাকআতের কথা উল্লেখ করেছেন।
এর প্রত্যেকটিই সহীহ।
অতএব,আমরা বুঝতে পারি,উমার রাযিআল্লাহু আনহুর আমলে ২০ রাকআত করে জামাআতে তারাবীহর নামায পড়া হত,এবং বাকী রাকআতগুলো ছিল বিতরের নামাযের।
প্রশ্ন হল,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহর নামায পড়তেন ১১ রাকআত,আর উমার রাযিআল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফতকালে চালু করলেন ২০ রাকআত!
☛ কেন?
এর উত্তর দিয়েছেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ।
তিনি বলেন,”যখন উবাই ইবনে কা'ব একটি জামাআতে লোকেদের নিয়ে নামায পড়তেন,তখন লোকেরা এত লম্বা সময় টানা দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না। যার ফলে তিনি রাকআত সংখ্যা বাড়িয়ে দেন (যাতে প্রতি রাকআতে কম সংখ্যক আয়াত তিলাওয়াত করা যায় এবং লোকেদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নামায পড়াটাও সহজ হয়)। প্রথমে তাঁরা ১১ বা ১৩ রাকআত নামাযই পড়তেন,কিন্ত লোকেদের জন্য এত লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ার কারণে তাঁরা তিনি রাকআত সংখ্যা বাড়িয়ে দেন।” [মাজমু আল-ফাতওয়া,২৩/১১৩]
রেফারেন্সঃ Islam QA
☛ তাহলে কি উমার রাযিআল্লাহু আনহু সুন্নাতের খেলাফ করলেন,অর্থ্যাৎ বিদআতের প্রচলন করলেন?
এর উত্তর হল,না।
কারণ হচ্ছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই নিজে ১১ বা ১৩ রাকআত নামায পড়তেন,কিন্ত তিনি কোথাও কিয়ামুল লাইলের রাকআত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলে যান নি।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ যেমন বলেন,”যদি কেউ মনে করে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন,আর সে তার থেকে বাড়াতে বা কমাতে পারবে না,তাহলে তার এই ধারণা ভুল।”
আর উমার রাযিআল্লাহু আনহুর মর্যাদা আমরা সবাই বেশ ভালভাবেই জানি। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম প্রিয় একজন সাহাবী,দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন,মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় খলিফা। যাঁকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন,”শয়তানও তোমাকে ভয় পায় হে উমার।” (আহমাদ,তিরমিযী,সিলসিলাহ সহীহাহ ১৬০৯নং)
অতএব,তিনি ইসলামে বিদআত চালু করবেন,এটা চিন্তা করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রেফারেন্সঃ Islam Web
► কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তরঃ
১) দেখতে পাচ্ছি তারাবীহর নামাযের নির্দিষ্ট কোন রাকআত সংখ্যা নেই। তাহলে আমি কত রাকআত নামায পড়ব?
উত্তরঃ
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন,
“এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে নামাযীর উপর নির্ভর করবে। সে যদি মনে করে,সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম,তাহলে তার জন্য ভাল হবে যদি সে (লম্বা সময় ধরে) ১০ রাকআত তারাবীহ পড়ে এবং ৩ রাকআত বিতর পড়ে,কারণ এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত। কিন্ত সে যদি মনে করে সে বেশিক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম নয়,তাহলে সে (ছোট ছোট করে) ২০ রাকআতও তারাবীহ পড়তে পারে,কারণ এটা মুসলিমদের মাঝে বেশ ভালভাবেই প্রচলিত। এ ব্যাপারে কোন সংখ্যাই অপছন্দনীয় নয়,আর এটা ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহসহ আমাদের বহু ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি।”
রেফারেন্সঃ Islam Web
অতএব,আপনি নিজে যা ভাল মনে করেন, সেভাবেই তারাবীহর নামায পড়ুন। ৮ রাকআত চাইলে ৮ রাকআত পড়ুন,১০ রাকআত চাইলে ১০ রাকআত পড়ুন,২০ রাকআত চাইলে ২০ রাকআত পড়ুন। এ ব্যাপারে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে রাকআত কম পড়লে অবশ্যই দীর্ঘ কিরআতে পড়া উত্তম । আর কিরআত দীর্ঘ করে পড়তে অক্ষম হলে ছোট ছোট ২০ রাকআত আমাদের দেশের মত পড়াই উত্তম ।
২) আমি ৮ রাকআত তারাবীহর পক্ষে,কিন্ত আমাদের এলাকার ইমাম ২০ রাকআত তারাবীহ পড়ান। আমি যদি ৮ রাকআত পড়ে জামাআত ছেড়ে দেই,তাহলে কি আমি পূর্ণ সওয়াব পাব?
উত্তরঃ
# রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
”যে ব্যক্তি ইমামের সাথে নামায পড়ে এবং তার নামায শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে থাকে (ইক্তিদা করে),সেই ব্যক্তির জন্য সারা রাত্রি কিয়াম করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়।” (আহমাদ,মুসনাদ,সহীহ আবূ দাউদ ১২২৭,সহীহ তিরমিযী,আলবানী ৬৪৬,সহীহ নাসাঈ,আলবানী ১৫১৮,সহীহ ইবনে মাজাহ,আলবানী ১৩২৭ নং)
অতএব,আপনার ইমাম যত রাকআত নামায পড়ান,হোক তা বিতরসহ ১১ রাকাআত বা ২৩ রাকআত,আপনি যদি পূর্ণ সওয়াব পেতে চান,আপনাকে ইমামের সাথে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নামায পড়তে হবে। না হলে পূর্ণ সওয়াব পাবেন না।
রেফারেন্সঃ “রমাযানের ফাযায়েল এবং রোযার মাসায়েল”,আবদুল হামীদ ফাইযী,তাওহীদ পাবলিকেশন্স
৩) তারাবীহর দুই রাকআত আর চার রাকআত শেষে বিশেষ দুইটি দুআ পড়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাই।
উত্তরঃ
এ রকম কোন দুআর ব্যাপারে হাদীস থেকে জানা যায় না। তবে মাঝে মাঝে এ দুআগুলো চাইলে পড়তে পারেন, কারণ এই দুআগুলোর অর্থ ঠিক আছে। তবে, এই দুআকে বাধ্যতামূলক মনে করে নিয়মিত পড়া অবশ্যই বিদআত বলে গণ্য হবে।
রেফারেন্সঃ Islam Web
যতদূর সম্ভব তারাবীহর নামাযের বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও যদি আরো কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে আমাদের ওয়ালে প্রশ্ন পোস্ট করুন। ইনশাআল্লাহ আমরা জবাব দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
EDS-1.7
© 2013 by Ask Islam Bangla.